জার্মান নাট্যকার বের্টোল্ট ব্রেখ্ট-এর নাটকে গালিলেও তাঁহার ছাত্র আন্দ্রেয়াকে বলিয়াছিলেন: দুর্ভাগা সেই দেশ যাহার নায়কের প্রয়োজন হয়। কথাটি সঙ্গত কারণেই প্রসিদ্ধ এবং সমাদৃত হইয়াছে। ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত এই নাটক লিখিবার সময় নাট্যকারের মানসলোকে সমকালের ছায়া পড়িয়াছিল, তাহা বলিবার অপেক্ষা রাখে না। বিশেষত জার্মানির অতিনায়কটি তত দিনে ত্রিভুবন গ্রাস করিবার প্রস্তুতি সম্পন্ন করিয়াছে। গালিলেওর উক্তিটি, এক কথায় মোক্ষম। তাহার পর আট দশক কাটিয়াছে, দুনিয়া জুড়িয়া নায়কনায়িকাদের দাপট আজও প্রবল। এবং, একুশ শতকের তৃতীয় দশকে পৌঁছাইয়াও, দেশে দেশে নাগরিকরা নায়ক ও নায়িকা খুঁজিতে পরম আগ্রহী, সেই সন্ধান বিফল হইলে তাঁহাদের অতৃপ্তির সীমা থাকে না। গালিলেও তথা ব্রেখ্ট-এর প্রজ্ঞা মহিমময় হইতে পারে, কিন্তু বাস্তব পৃথিবীতে আজও আন্দ্রেয়ার বচন অনস্বীকার্য: দুর্ভাগা সেই দেশ যেখানে নায়ক নাই।
প্রশ্ন উঠিতে পারে, নেতা বা নায়কের প্রয়োজনকে কটাক্ষ করা হইবেই বা কেন? পরিবার, গোষ্ঠী, সংগঠন, প্রতিষ্ঠান— সমস্ত পরিসরে নেতৃত্ব আবশ্যক হয়, তাহা না হইলে সেই সমষ্টি আপন কাজ সুষ্ঠু ভাবে সম্পাদন করিতে পারে না, ‘নৈরাজ্য’ কার্যত অচল, বিধ্বংসী, আত্মঘাতী। পরিসরটি যত বৃহৎ এবং জটিল, নেতৃত্বের প্রয়োজন স্বাভাবিক ভাবেই তত বেশি। সেই প্রয়োজন নিছক পথ প্রদর্শনের জন্য নহে, ব্যক্তির সমষ্টিচেতনা জাগ্রত করিবার দায়িত্ব পালনও যথার্থ নেতৃত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। ভারতের গত শতকের ইতিহাসে এই দায়িত্ব পালনের অনন্য দৃষ্টান্ত হিসাবে একবাক্যে উচ্চারিত হইবে মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর নাম। ঔপনিবেশিক ভারতের যে তাঁহাকে প্রয়োজন হইয়াছিল, তাহা দেশ বা জাতির দুর্ভাগ্য নহে। তিনি ছিলেন, ইহাই ভারতের সৌভাগ্য। ইউরোপের দেশে দেশে যখন অতিনায়কদের হিংস্র পিশাচলীলা, ভারতে ঠিক সেই সময়েই এক সত্যাগ্রহীর নেতৃত্বে অহিংস আন্দোলনের মধ্য দিয়া জাতি আপন সত্তা খুঁজিতেছে— এই সমাপতন দেখাইয়া দেয় যে, নেতৃত্ব সমস্যার নহে, প্রশ্ন হইল: নেতৃত্ব চরিত্রে কেমন, কী তাহার পথ।
সমকালীন ভারতেও সেই প্রশ্নই প্রাসঙ্গিক। নায়ক হইতে অতিনায়ক হইয়া উঠিবার তাড়নায় গণতন্ত্রের নীতি ও আদর্শ লঙ্ঘনের যে বুলডোজ়ার চলিতেছে তাহা লইয়া নূতন করিয়া বলিবার কিছু নাই। কিন্তু তাহার বিপরীতে এই সত্যও উন্মোচিত হইয়াছে যে, নেতৃত্বের ঘাটতি গণতন্ত্রের পক্ষে বড় রকমের সমস্যার কারণ হইতে পারে। নরেন্দ্র মোদীর শাসনের মোকাবিলায় সামগ্রিক ভাবে বিরোধী রাজনীতির এবং বিশেষ ভাবে কংগ্রেসের ব্যর্থতার পিছনে নেতৃত্বের অভাব কতটা দায়ী, গত লোকসভা নির্বাচনের ইতিহাস তাহা প্রমাণ করিয়াছে। আজও সেই অভাব পূরণের বিশ্বাসযোগ্য কোনও উদ্যোগ বিরোধী শিবিরে নাই। বিভিন্ন রাজ্যের পরিসরেও নেতৃত্বের ভূমিকা প্রাসঙ্গিক হইয়া উঠিতেছে। বিধানসভা নির্বাচনের প্রস্তুতিপর্বে পশ্চিমবঙ্গের অভিজ্ঞতাও এই প্রসঙ্গে তাৎপর্যপূর্ণ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নীতি ও আচরণ লইয়া বিস্তর প্রশ্ন থাকিতে পারে, কিন্তু তাঁহার অতি বড় বিরোধীও অস্বীকার করিবেন না যে, নেত্রী হিসাবে তিনি আপনাকে দৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন এবং সেই নেতৃত্ব প্রবল ভাবে ধরিয়া রাখিয়াছেন। বস্তুত, তাঁহার এই প্রবল ভূমিকার বিপরীতে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি এখনও অবধি নেতৃত্বের কোনও সম্ভাবনাই তৈরি করিতে পারে নাই, দিল্লি হইতে বড় মেজো ছোট নানা মাপের নায়কনায়িকাদের উড়াইয়া আনিয়া জনমনে দাগ কাটিবার চেষ্টা চলিতেছে, হেলিকপ্টার আকাশে উঠিতেই সম্ভবত সেই আঁচড় বিলীন হইতেছে। নেতৃত্বের সন্ধানে রকমারি চরিত্রের এই দৌড়াদৌড়ি দেখিয়া ব্রেখ্ট আমোদ পাইতেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy