ইংরেজ কবি বলিয়াছিলেন, একটি শব্দ বারংবার ব্যবহারে কলুষিত হইয়াছে, তিনি আর তাহা ব্যবহারে নারাজ। শব্দটি কী ছিল, কাব্যপ্রেমীরা জানেন। এই বার পশ্চিমবঙ্গের ভোটের প্রচার দেখিয়া মনে হইতেছে, আরও একটি শব্দ বার বার ব্যবহার ও অপব্যবহারে বড়ই ধ্বস্ত হইয়া গেল, রাজনীতিপ্রেমীরা জানেন। বাস্তবিক, ‘বহিরাগত’ শব্দটি আর কখনও তাহার স্বাভাবিক ব্যঞ্জনা ফিরিয়া পাইবে, না কি ঘৃণিত ও নিন্দাসূচক অপশব্দ হিসাবেই অতঃপর পরিগণিত হইবে, ইহাই আপাতত ভাবাইতেছে বিস্তর। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে বিরোধীরা বহিরাগত বলিতেছেন। মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁহার দল বিরোধীদের বহিরাগত বলিতেছেন। রাজ্যের বাহির হইতে আসা বিরোধী নেতা প্রণেতা ভক্ত সমর্থকদের বহিরাগত বলা হইতেছে। জেলার বাহির হইতে আসিয়া জেলার আসনে দাঁড়ানো প্রার্থীকে বহিরাগত বলা হইতেছে। প্রবাসী বিজ্ঞজনেরা এই বারের নির্বাচনী পরিবেশ বা পদ্ধতি বা পরিস্থিতি লইয়া মন্তব্য করিলে সমাজমাধ্যমে ভাসিয়া আসিতেছে সজোর আক্রমণ— ‘বাহির’-এর লোক কথা কহিতেছেন কেন! হিন্দুত্ববাদীরা যে অন্য ধর্মাবলম্বী ভারতীয়দের গোড়া হইতেই বাহিরের লোক ঠাহরাইয়া রাখিয়াছেন, এবং সেই অপবাদ যে পুরুষানুক্রমেও ঘুচিবার নহে, তাহা তো ইতিমধ্যে দিকে দিকে প্রমাণিত ও প্রচারিত হইয়াছে বটেই। দেখিয়া শুনিয়া মনে হয়, এই যুক্তিতে নির্বাচনী প্রার্থী হইতে ইচ্ছুক প্রত্যেক নাগরিক তাঁহার জন্ম-অঞ্চলের আসনেই দাঁড়াইলে ঠিক হয়, বাকি সব বেঠিক। কিংবা সমর্থন করিতে চাহিলে কেবল নিজের পাড়ার নেতা বা বিজ্ঞজনকেই সমর্থন করা ভাল, বাকি সব দিকে দৃষ্টি বন্ধ রাখিয়া। পণ্ডিতজন বা অপণ্ডিত, সকলেরই উচিত কেবল নিজের সঙ্কীর্ণ পরিসরটিতে নিজেকে বন্ধ করিয়া রাখা, পাছে লোকে কিছু বলে। এবং হিন্দু ছাড়া সকলেরই মানে মানে ভারত হইতে প্রস্থান করা জরুরি, এই মুহূর্তে। সব মিলাইয়া, ‘বহিরাগত’ শব্দের অপব্যবহার এবং অতিব্যবহার মনে করাইতেছে, বাংলার মানুষ ও ভারতের মানুষ আরও একটি বিভাজন-জাদুদণ্ডের অপেক্ষায় ছিলেন, তাঁহারা তাহা পাইয়া গিয়াছেন। ঘৃণা ও বিদ্বেষের সুবিস্তৃত সুগভীর সাগরে নিমজ্জনের আরও একটি কারণ মিলিয়াছে— ইহাকে উহাকে তাহাকে বহিরাগত করিয়া দাও!
দুইটি কথা এই প্রসঙ্গে বলিতে হয়। এক, পৃথিবীতে বহু সুঘটন ঘটিয়াছে বহিরাগতের হাত ধরিয়াই। উদাহরণ নিষ্প্রয়োজন। ভারতের জাতীয়তাবাদী হিসাবে যাঁহারা আত্মগৌরবে মজিয়া আছেন, তাঁহারা মানুন না মানুন, ভারত স্থানটি তৈরি হইয়াছে বাহির হইতে গ্রহণ করিতে করিতেই। কোনও কিছুকেই এই ভূমির একান্ত নিজস্ব বলিয়া বর্ণনা করা মুশকিল— আর্য পরিচিতিটিকে নহে, হিন্দু নামটিকে নহে, হিন্দি ভাষাটিকে নহে, ‘ভারতীয়’ হিসাবে অধুনা মান্য খাদ্য-পরিধান-আচার-বিচারের বহু কিছুকেই নহে। এমনকি, ‘হিন্দি’ শব্দটিও ধ্রুপদী ফারসি হইতে আগত। হয়তো একমাত্র আদিবাসী সমাজই ভারতভূমির নিজস্ব ধারাটি বহন করিতেছে— যাহাদের উৎখাত ও অপমানে জাতীয়তাবাদীরা সতত তৎপর। এই কথাটিই রবীন্দ্রনাথ বার বার বলিয়া গিয়াছেন, আরও বহু বাঙালি ‘মহাপুরুষ’-এর মতোই। তাই বাংলায় ‘কবিবর’-এর নামটি মুখে আনিবার আগে, আর্য-অনার্য-হিন্দু-মুসলমান-পারসিক-খ্রিস্টানি সম্বলিত ভারততীর্থের ছবিটি প্রধানমন্ত্রী মোদী ও তাঁহার দল কল্পনায় আগে স্বীকার করিবেন, মান্যতা দিবেন। নতুবা, তাঁহাদের দেখিয়া বাংলায় ‘বহিরাগত’ই মনে হইবে।
দুই, এইখানেই আসে একটি বিবেচনার প্রশ্ন। বাহিরের নিকট নিজেকে খুলিয়া রাখিয়াও নিজের কিছু বিশেষত্ব একান্ত করিয়া রাখিবার একটি প্রবণতা কিংবা ইচ্ছা মানবসভ্যতার আদিম ধর্ম। বাঙালি সমাজের সেই ‘ধর্ম’-মতে, যাহা কিছু এখানকার ঐতিহ্যে প্রচলিত, সমাজমনে প্রোথিত, তাহাকে স্বীকৃতি দেওয়া কিংবা সম্মান জানানোকে আবার সঙ্কীর্ণ রাজনীতি বলিয়া দাগাইলে মুশকিল। বাংলা বাঙালির ভাষা, সেই বাঙালি নিশ্চয় সব সংস্কৃতি হইতে শিখিতে-জানিতে উৎসুক— সেই ঔৎসুক্যের কথা অতীত হইতে বর্তমান প্রজন্ম ধারণ করিতেছে। কিন্তু তাহা বলিয়া আজ যাঁহারা বাঙালির জন্য হিন্দিতে রাজনীতি করিবার, ভোটের বক্তৃতা হইতে প্রার্থী-তালিকার বিজ্ঞপ্তি, সবই হিন্দিতে করিবার সিদ্ধান্ত লইয়াছেন— তাঁহাদের ‘বহিরাগত’ বলা এই জন্যই যুক্তিসম্মত ও আবেগসমর্থিত। কে বহিরাহত, কে নহে— তাহা কোনও কষ্টিপাথরে নির্ধারিত হয় না। আচারব্যবহারের বিবেচনায় ঘরের লোকও পর হইয়া যান, ভূমিপুত্রও হইতে পারেন বহিরাগত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy