—ফাইল চিত্র।
কলকাতায় জলকষ্ট আসন্ন, সতর্ক করেছেন মেয়র ফিরহাদ হাকিম। গঙ্গার জলস্তর দ্রুত নীচে নামছে, ভাটার সময় পুরসভা জল তুললে উঠছে শুধু কাদামাটি। গঙ্গার জল পরিস্রুত করে গোটা কলকাতায় সরবরাহ করে পুরসভা। অতএব উৎসে ঘাটতি হলে মহানগর বিপন্ন হবে। অপর যে কারণে সঙ্কট ঘনিয়ে উঠছে, তার কথা মেয়র ওই সাংবাদিক সম্মেলনে উল্লেখ করেননি। তা হল, ভূগর্ভের জলস্তর নেমে যাওয়া। কেন্দ্রীয় ভূগর্ভ জল পর্ষদের পঞ্চবার্ষিকী রিপোর্টে ধরা পড়েছে যে, ২০১৭-২৩ সালের মধ্যে কলকাতার ভূগর্ভস্থ জলের স্তর নেমেছে দু’মিটারেরও বেশি, জলভান্ডার কমেছে অন্তত আঠারো শতাংশ। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় জলস্তর নেমেছে আড়াই মিটার, ক্ষয় হয়েছে সাতাশ শতাংশ জল। এই হারে ক্ষয় হতে থাকলে দু’টি সঙ্কট প্রবল হবে। এক, জল মিলবে না। আর দুই, জলে আর্সেনিকের পরিমাণ বাড়তে থাকবে। বিত্তবান পরিবারে নানা ভাবে পানীয় জল দূষণমুক্ত করে খাওয়ার উপায় থাকলেও, দরিদ্র ও নিম্নবিত্তদের সে উপায় নেই। এমনকি পুরসভা বা স্থানীয় মিউনিসিপ্যালিটি পরিস্রুত পানীয় জল সরবরাহ করলেও তাঁরা সম্পূর্ণ নিরাপদ নন, কারণ শস্য ও তরিতরকারিতে আর্সেনিক মিলছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমীক্ষায় (২০১৯) দেখা গিয়েছে যে, কলকাতার এক জন প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক দিনে ৭৬ মাইক্রোগ্রাম আর্সেনিক গ্রহণ করছেন খাবারের মাধ্যমে। দীর্ঘ মেয়াদে তা যে স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বাড়াবে, বিশেষত অপুষ্টদের, তাতে সন্দেহ নেই। জল উত্তোলনের হার কমানো না গেলে দ্রুত জলভান্ডার অর্ধেক হয়ে যাবে, সতর্ক করেছে পর্ষদ।
কিন্তু জলসঙ্কট কঠিন হয়ে যতক্ষণ দেখা না দিচ্ছে, ততক্ষণ এই ধরনের সতর্কবার্তায় কে-ই বা কান দেয়? মেয়র এখন পরামর্শ দিচ্ছেন জল সংরক্ষণের, অপচয় কমানোর। প্রতিটি নাগরিকেরই এ বিষয়ে সতর্ক, সক্রিয় হওয়া দরকার, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু বিপদ ঘাড়ের উপর এসে গেলে নাগরিকের উপর সমাধানের দায় চাপিয়ে পুর কর্তৃপক্ষের সরে দাঁড়ানোর পরিচিত অভ্যাসটিও জনস্বার্থের বিপরীতে যায়। প্রতি বছর ডেঙ্গি বা ম্যালেরিয়া মহামারির আকার নিলে পুরসভা প্রচারে নামে। নাগরিকের বিবেক ও কর্তব্যবোধের কাছে আবেদন করেই কাজ সারে। কিন্তু সারা বছর পতঙ্গ নিয়ন্ত্রণের দ্বারা রোগ নিবারণের কাজ অবহেলিত হয়। তেমনই, বৃষ্টির জল সংরক্ষণ, ভূগর্ভের জল উত্তোলনে নিয়ন্ত্রণ, এবং পুরসভার সরবরাহ করা পরিস্রুত জলের অপচয় নিবারণের জন্য পুরসভা কতটুকু সচেষ্ট? কলকাতা পুরসভার নিজস্ব পরিসংখ্যান (২০২২) অনুসারে, প্রতি দিন প্রায় ১৫৪ কোটি লিটার জল পরিশোধন করে সরবরাহ করা হয়। যার মধ্যে দৈনিক সাড়ে ৩৬ কোটি লিটার জল (২৩ শতাংশ) অপচয় হয়। কলকাতায় মাথাপিছু দৈনিক ১৫০ লিটার জল দেয় পুরসভা। সেই হিসেবে এ শহরে প্রতি দিন ২৪ লক্ষ লোকের ব্যবহারের জল নালা-নর্দমা দিয়ে বেরিয়ে যায়। তার অনেকটার জন্যই নাগরিক দায়ী, কিন্তু পুরসভাও কি জল অপচয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে দায়ী নয়?
এর সঙ্গে ধরতে হবে বড় বড় আবাসন এবং জলব্যবসায়ীদের ভূগর্ভের জল উত্তোলন থেকে বিরত করতে পুরসভার ব্যর্থতাকে। বৃষ্টির জল সংরক্ষণে অবহেলার জন্যও জলের বিপুল অপচয় হচ্ছে। বিজ্ঞানীদের মতে, জলের যথাযথ সংরক্ষণ করলে একটি গৃহস্থালির সত্তর শতাংশ জলের প্রয়োজনই মেটানো যায়, কিন্তু ভারতে বৃষ্টির জলের মাত্র আট শতাংশ সংরক্ষিত হয়। রাজ্যের গ্রামীণ এলাকায় ‘জল ধরো জল ভরো’ প্রকল্প চলছে, কিন্তু পুর এলাকায় কী উদ্যোগ করা হয়েছে? রাজ্য সরকারের দফতর, পুলিশ থানা এবং পুরসভার ভবনগুলি এ বিষয়ে কী দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে, কী উদাহরণ রাখছেন স্বয়ং মহানাগরিক এবং তাঁর দলের মন্ত্রীরা? নাগরিককে যদি সত্যিই জল সংরক্ষণে উৎসাহিত করতে হয়, তবে তা করতে হবে কাজ দেখিয়ে। কেবল কথায় এই মহাসঙ্কট এড়ানো যাবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy