আইন বাইরের বিষয়, কোন কাজ শাস্তিযোগ্য, সে বিষয়ে নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। প্রতীকী ছবি।
যদি স্বর্গ কোথাও থাকে, তবে তা এখানেই— কাশ্মীর দেখে লিখেছিলেন এক কবি। বঙ্গের স্থান আপাতত তার বিপরীতে। বাঘের থাবার মতো রোদ, আগুনের জিহ্বার মতো বাতাস, প্রেশার কুকার-সম শয়নকক্ষ— নরক যদি থাকে তবে তা বৈশাখের বাংলায়। নরকের যত বর্ণনা মেলে পুরাণে বা ধ্রুপদী সাহিত্যে, তার সবেতেই আগুনের আধিক্য। “অন্ধকারে চৌরাশিটা নরকের কুণ্ড, তাহাতে ডুবায়ে ধরে পাতকীর মুণ্ড”— ছাত্রের মুখে আবৃত্তি শুনে এক পণ্ডিতমশাই বেজায় চটে গিয়েছিলেন, তাঁকে ‘পাতকী’ বলা হচ্ছে মনে করে। আজ সুকুমার রায়ের সেই গল্পের (নতুন পণ্ডিত) স্কুলপড়ুয়ারা যেন শতাব্দী-পার থেকে দেখছে আর এক কৌতুক অভিনয়— বিশ্ব উষ্ণায়নে সর্বত্র জ্বলছে অগ্নিকুণ্ড, এমনই তার দাপট যে ছুটি হয়ে গিয়েছে ইস্কুলে। এ দিকে পাতকী খুঁজতে গাঁ উজাড়। পরিবেশ-কর্মীরা আঙুল তুলছেন নেতা-মন্ত্রী, শিল্পপতিদের দিকে। হিমবাহ ধ্বস্ত, ভূগর্ভ নির্জলা, বিপুল জনক্ষয় আগতপ্রায়— নরক আর কল্পকথা নয়। তবু কেন পরিবেশ হননে রাশ টানেনি মানুষ, কেন অরণ্য-পর্বত ধ্বংস করে লোকালয় মাথা তুলছে, তার কারণ কোনও যুগে, কোনও কালে, নরকের ভয় দেখিয়ে মানুষের প্রবৃত্তিকে বশে আনা যায়নি। মহাকবি দান্তে বর্ণনা করেছিলেন, খুনিদের শাস্তি দিতে ফুটন্ত রক্তে তাদের সিদ্ধ করছে দানবরা। ভাগবত পুরাণ বলছে, যারা রসনার পরিতৃপ্তির জন্য নিরীহ পশুপাখিকে হত্যা করে, তাদের নাকি ‘কুম্ভীপাক’ নরকে যমদূতরা ফুটন্ত তেলে ভাজে। এত ভয় দেখানোতেও কি খুনজখমে রাশ টেনেছে মানুষ? না কি বাঙালি কখনও ইলিশ, কচি পাঁঠা ভক্ষণ থেকে বিরত হয়েছে? নরক এক সংশয়ময় সম্ভাবনা, জীবন তার রং-রস নিয়ে মহাসমারোহে বর্তমান।
প্রাচীন গ্রন্থে নরকের আলোচনা বরং আগ্রহ জাগায় অপর একটি কারণে— কোন কাজটি নরকের যোগ্য বলে মনে করা হয়েছে, তার বিচার। আইন বাইরের বিষয়, কোন কাজ শাস্তিযোগ্য, সে বিষয়ে নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের মতো ভয়ানক অন্যায়ও তাই হস্তিনাপুর রাজসভায় প্রতিরোধযোগ্য অপরাধ বলে প্রতিপন্ন হয়নি। কিন্তু আইনের চোখে যা শাস্তিযোগ্য নয়, অপরাধীর অন্তর সেই কাজকে কিছুতেই বিস্মৃত হতে দেয় না। এখানেই নৈতিকতার জোর— তার কণ্ঠ অশ্রুত, কিন্তু অপ্রতিরোধ্য। মহাভারতে দেখা যায়, চরম সঙ্কটের সময়ে সেই গোপন কণ্ঠ ধ্বনিত হচ্ছে এক মহাবীরের শপথে। অভিমন্যু বধের পরে শোকতপ্ত অর্জুন পুত্রহন্তা জয়দ্রথকে বধ করার ঘোর শপথ নিয়ে বললেন, ব্যর্থ হলে যেন চরম অপরাধীদের যোগ্য নরকে স্থান হয় তাঁর। কারা সেই পাপী? পিতৃঘাতী, মাতৃঘাতী, গো-ব্রাহ্মণ হত্যাকারী প্রত্যাশিত ভাবেই এল অর্জুনের তালিকায়। একই সঙ্গে অর্জুন উচ্চারণ করলেন— ‘ভূতপূর্ব স্ত্রীর নিন্দাকারী।’ পূর্বপ্রণয়ীর নিন্দা ক্ষুদ্রচিত্ত মানুষের পরিচয়, কোনও শাস্ত্র তাকে অপরাধ বলে দেখে না, প্রতিবিধানও কিছু নেই। কিন্তু মানবিকতার নিরিখে তা যে কত বড় অপরাধ, তা সর্বসমক্ষে ঘোষণা করলেন অর্জুনের মতো প্রেমিক পুরুষ। তেমনই, যিনি অতিথিকে আহার দেন না, যিনি স্ত্রী-পুত্রকে ভাগ না দিয়ে মিষ্টান্ন ভোজন করেন, তাঁদের অর্জুন রাখলেন রণভীত ক্ষত্রিয়, কৃতঘ্ন মানুষের সঙ্গে সমান স্থানে— তাঁরা সকলে একই ভাবে নরকের উপযোগী।
পুত্রশোকের প্রাবল্যে মূর্ছা থেকে সদ্য-জাগ্রত কোনও পিতার মুখে নরক নিয়ে এমন বিচার কি সম্ভব? না কি, মহাভারতের বহু সংলাপের মতো, একেও ‘প্রক্ষিপ্ত’, অর্থাৎ পরবর্তী কালের কোনও অতি-উৎসাহী লেখকের সংযোজন বলে ধরে নিতে হবে? এ কথাগুলি যিনি, যবেই রচনা করে থাকুন, নরকযাত্রার ক্লেশকে স্বেচ্ছায় আহ্বানের মধ্যে এই স্বীকৃতিটুকু রয়েছে যে, নরক-কল্পনা কেবল ভয় দেখিয়ে অপরাধ থেকে নিবৃত্ত করার জন্য নয়। যে সব কৃতকর্ম শোচনীয়, ক্ষমার অযোগ্য, কখনও তার মুখোমুখি হতেই হয়। নরকের নির্মাণ শাস্তি দিতে নয়, তার প্রয়োজন বিবেক জাগানো। যত দিন না কৃতকর্মকে ‘পাপ’ বলে অনুভব করছে দুষ্কৃতী, তত দিন তাকে তা নিয়ত স্মরণ করায় নরকের পীড়ন। হয়তো এই জন্যই বিচিত্র পাপের জন্য বিচিত্র নরকের কল্পনা। পাতাল কিংবা ‘ইনফার্নো’ কল্পনার উদ্দেশ্য অকারণ পীড়ন নয়, আপন নিষ্ঠুরতার অনুভব। প্রকৃতির ধনসম্বল ধ্বংস করে যাঁরা ব্যক্তিগত ‘সম্পদ’ তৈরি করেছেন, এক দিন হয়তো তাঁদের প্রতাপের সম্মুখে আইনের শাসন নিহত গাছের ছায়ার মতোই নীরবে সরে গিয়েছিল। আজ উত্তপ্ত বিশ্ব দাঁড়িয়ে দুয়ারে, অনুশোচনার অপেক্ষায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy