তার ‘অপরাধ’, সে পড়ে গিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের স্বপ্নপ্রকল্প ‘সেন্ট্রাল ভিস্টা’র উপরে। এখন ঠাঁই বদল ছাড়া গতি নেই। দিল্লির জাতীয় সংগ্রহশালা তথা ন্যাশনাল মিউজ়িয়ম কর্তৃপক্ষের কাছে কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের নোটিস এসেছে, এই বছরের মধ্যে ‘বাড়ি ফাঁকা করা’র। আগামী বছর মার্চের মধ্যে এই সংগ্রহশালা ভেঙে ফেলা হবে, সেখানে গড়া হবে সরকারি ভবন, আর নর্থ ও সাউথ ব্লকে তৈরি হবে নতুন সংগ্রহশালা, নাম ‘যুগে যুগীন ভারত’— সে নাকি হবে এক বিরাট প্রকল্প, বিপুল অর্থব্যয়ে তুলে ধরা হবে ভারতের পাঁচ হাজার বছরেরও বেশি প্রাচীন সভ্যতা ও ঐতিহ্য। অতএব ‘হেথা হতে যাও, পুরাতন’!
নরেন্দ্র মোদী সরকারের এই সিদ্ধান্তে ধন্দ জাগে, হেথায় নূতন খেলা আরম্ভ হয়েছে। যে খেলা— বিরোধীরা এরই মধ্যে প্রশ্ন তুলেছেন— পুরনো জমানার সব কিছুকে স্রেফ অস্বীকারেই থেমে থাকে না, তাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চায়, এবং বোঝাতে চায় এই শাসক যা করছে সেটাই যুক্তিযুক্ত। ১৯৪৭-এ স্বাধীন হওয়া দেশের এক সাংস্কৃতিক প্রত্যাশা ও উচ্চাশার ফল ন্যাশনাল মিউজ়িয়ম, প্রাচীন সভ্যতা পেরিয়ে এসে, ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয়ে আধুনিকতার পথে জরুরি পাদবিক্ষেপ। এই সংগ্রহশালা গড়ে উঠেছে একটু একটু করে, এমনকি এই সে দিন— ২০১৭ সাল অবধি সেখানে নির্মাণ চলেছে। আজ সেন্ট্রাল ভিস্টা, নতুন সংসদ ভবনের মতো ‘প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের প্রকল্প’গুলি বাস্তব করতে কেন্দ্র উঠেপড়ে লেগেছে, তার বলি হচ্ছে ন্যাশনাল মিউজ়িয়ম। নতুন, আরও বড় ও চোখ-ধাঁধানো সংগ্রহশালা তৈরি করাটা বড় কথা নয়, আসল কথা হল আগের আমলে যা হয়েছে তা মুছে ফেলা। কিন্তু তা করতে গিয়ে যে পক্ষান্তরে স্বাধীন ভারতের সাংস্কৃতিক আবেগকেও অস্বীকার করছে এই সরকার, তা কি তারা বুঝছে?
মিউজ়িয়মের বিপুল ও অমূল্য সংগ্রহের স্থানান্তর আর একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ দিক। যে কোনও সংগ্রহশালার ক্ষেত্রেই এ অতি দুরূহ কাজ, আর এ তো ন্যাশনাল মিউজ়িয়ম, যেখানে হরপ্পা সভ্যতার প্রত্নবস্তুও রাখা আছে, মোট সংগ্রহ প্রায় দু’লাখ, ঐতিহ্যমূল্যের দিক থেকে দেখলে প্রতিটি প্রদর্শ মহার্ঘ। এ-হেন সংগ্রহ কি স্রেফ এক সরকারি নোটিসে বাকি বছরের মধ্যে পুরনো ঠিকানা থেকে সরিয়ে ফেলা যায়? ব্রিটিশ মিউজ়িয়মের মাত্র ১১৫ মিটার দীর্ঘ একটি গ্যালারির দু’হাজার সংগ্রহ সরিয়ে তাকে ফের গুছিয়ে তুলতে কর্তৃপক্ষ সময় নিয়েছিলেন দু’বছর, কারণ এই স্থানান্তর অতি ঝুঁকির কাজ; অজস্র জিনিস আছে যাতে হাত দেওয়াই দুষ্কর। একই কথা প্রযোজ্য ন্যাশনাল মিউজ়িয়মের ক্ষেত্রেও: এর বহু শিল্পবস্তু শুধু ভারতের নয়, বিশ্বেরও ‘হেরিটেজ’। এই বিরাট ও অমূল্য সংগ্রহের স্থানান্তর, এবং নতুন সংগ্রহশালা ভবন গড়ে ওঠা ইস্তক অস্থায়ী ঠিকানায় তার রক্ষণ অতি জরুরি এক কাজ— একই সঙ্গে চূড়ান্ত পেশাদারিত্ব, বিজ্ঞানসম্মত সংরক্ষণ সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান ও এই কাজের প্রতি ভালবাসা ছাড়া যা নির্বিঘ্ন হবে না কখনওই। প্রাক্তন সংস্কৃতি সচিবের মতো কেউ কেউ এ নিয়ে কেন্দ্রকে প্রশ্ন করে কেবল দায়সারা উত্তর পেয়েছেন। সেখানেই ভয়। অমূল্য প্রাচীন সংগ্রহের অবহেলার, এমনকি পাচার, চোরাচালানের শঙ্কাও অমূলক নয়। জাতীয় সংগ্রহশালা সরকারের নয়, সমগ্র দেশের, দেশবাসীর সম্পদ, মোদী সরকার তা কবে বুঝবে?
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)