—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
মিড-ডে মিলের খাবার দিনে-দিনে অখাদ্যে পরিণত হচ্ছে, আক্ষেপ করেছেন মুর্শিদাবাদের এক স্কুল-শিক্ষক। ‘অখাদ্য’ শব্দের প্রয়োগ এ ক্ষেত্রে যথাযথ। যা দেহের পুষ্টিবিধান করে, মনকে তৃপ্তি দেয়, মানবসমাজ চিরকাল তাকেই ‘খাদ্য’ বলে। যা অরুচিকর, অসার, তাকে ‘অখাদ্য’ বলাই উচিত। মিড-ডে মিলের জন্য যা সরকারি বরাদ্দ (প্রাথমিক স্তরে মাথাপিছু পাঁচ টাকা পঁয়তাল্লিশ পয়সা, এবং উচ্চ প্রাথমিক স্তরের জন্য আট টাকা সতেরো পয়সা), তাতে যে প্রকৃত খাদ্য শিশুর পাতে তুলে দেওয়া যায় না, তা পশ্চিমবঙ্গ সরকারও জানে। সম্ভবত সেই জন্যই পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগের কয়েক মাস প্রতি সপ্তাহে মাথাপিছু কুড়ি টাকা বাড়তি বরাদ্দ করেছিল শিক্ষা দফতর, এবং সেই টাকায় কত ডিম, মাংস, ফলমূল পরিবেশন করতে হবে, তারও তালিকা দিয়েছিল। ভোট ফুরোতেই বরাদ্দ গায়েব হল। শিশুর পাতে ফিরল জলবৎ ডাল, আনাজ-বিরল ঝোল। শিশুর মুখের খাদ্যকেও ভোটের টোপ করা যায়, দেখল রাজ্যবাসী। ভোট ফুরোলে কি শিশুর পুষ্টির প্রয়োজনও ফুরোয়? না কি, নেতাদের ভোটের খিদে মিটে গেলে শিশুর আর খিদে পায় না? খাদ্যের মূল্যস্ফীতি যেখানে সরকারি হিসাবেই প্রতি মাসে নতুন নজির তৈরি করছে, সেখানে মিড-ডে মিলের বরাদ্দ না বাড়ানোর মানে দাঁড়ায় অখাদ্য পরিবেশন, তা সরকার ভালই বোঝে। কিন্তু দরিদ্র শিশুকে প্রতারণা করতে লজ্জা পায় না।
কেবল মিড-ডে মিল নয়, উন্নয়ন তথা সামাজিক সুরক্ষার প্রায় সব প্রকল্পই হয়ে দাঁড়িয়েছে দেখানোর বস্তু, কাজের বস্তু নয়। ‘খাদ্যসাথী’ মানেই পুষ্টিবিধান, ‘কন্যাশ্রী’ মানেই নারীশিক্ষা, ‘স্বাস্থ্যসাথী’ মানেই সুচিকিৎসা— এমনই যেন ধরে নিতে হবে। বিদ্যুৎ কিংবা পানীয় জলের সংযোগ থাকলেই ধরা হবে, গৃহস্থের আলো-জলের চাহিদা মিটেছে। বাস্তবিক জল বা বিদ্যুৎ সরবরাহ হচ্ছে কি না, সে প্রশ্ন তোলা হয় না। প্রকল্পের উদ্দেশ্য কী ছিল, সেখানে পৌঁছনো গেল কি না, কতটা বাকি রয়ে গেল, তার কোনও উত্তর মেলে না। কেন্দ্রীয় সরকারও উন্নয়নের প্রকল্পগুলির প্রকৃত মূল্যায়নের বিষয়ে একই রকম ভাবে বিচারহীনতার পক্ষপাতী। ফলে, রাজ্য-রাজনীতিতে এক ধরনের বাদানুবাদ তৈরি হয়েছে, যা মিড-ডে মিলের খাদ্যের মতোই অসার। সেখানে শাসক সব বিষয়েই দাবি করেন একশো শতাংশ সাফল্য, এবং বিরোধী শাসকের একশো শতাংশ ব্যর্থতার অভিযোগ করেন। এই ছেলেখেলার ফল হয়েছে এই যে, ভারত শিশু-অপুষ্টিতে পড়শি দেশগুলির চাইতেও পিছিয়ে। কেন, তা নিয়ে কোনও প্রশ্ন ওঠে না— বিধানসভা, সংসদেও নয়, ভোটের প্রচারপর্বেও নয়। এই বিতর্কহীনতার পিছনে গূঢ় অভিসন্ধির আভাস মেলে যখন দেখা যায় যে অঙ্গনওয়াড়ি এবং মিড-ডে মিল, শিশুপুষ্টির এই দুই প্রধান প্রকল্পের প্রতি কেন্দ্র এবং রাজ্যের সরকার সমান কৃপণ।
মনে রাখতে হবে, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে অথবা সরকারি স্কুলগুলিতে রান্না-করা খাবার পরিবেশন শিশুর প্রতি করুণার নিদর্শন নয়। ভারতে খাদ্যের অধিকার আইন (২০১৩) পাশ করা হয়েছে। মিড-ডে মিলের ‘খাদ্য’ কেমন হবে, সে বিষয়ে সংশয়ের অবকাশ রাখেনি সুপ্রিম কোর্ট। রান্না-করা খাবারে প্রাথমিকের পড়ুয়াদের দিতে হবে দৈনিক অন্তত ৩০০ ক্যালরি, যার মধ্যে আট থেকে বারো গ্রাম প্রোটিন রাখতে হবে, এমনই নির্দেশ দিয়েছিল শীর্ষ আদালত (২০০১)। সুতরাং মিড-ডে মিল কোনও অনুদান নয়— অধিকার। সাম্প্রতিকতম জাতীয় পরিবার সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ভারতে তিন জন শিশুর এক জনই অপুষ্ট। অতএব প্রাক্-প্রাথমিক থেকে উচ্চ প্রাথমিক পর্যন্ত শিশুদের পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহের উপযুক্ত অর্থ বরাদ্দ করতে হবে কেন্দ্র এবং রাজ্যকে। আর শিশুপুষ্টি, খাদ্যের অধিকার, বা সংবিধানের মর্যাদার সুরক্ষা নিয়ে সরকারের মাথাব্যথা যদি না-ই থাকে, তা হলে মিড-ডে মিল প্রকল্পের অর্থ কী পড়ে রইল?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy