Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪
Chopra Assault Case

এমন হয়েই থাকে

চোপড়ার ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রী নড়েচড়ে বসেছেন। তিনি সম্ভবত টের পাচ্ছেন যে, এক দিকে খাজনা আদায় এবং অন্য দিকে ত্রাস রাজ্যের নাগরিকদের মনে বিপুল ক্ষোভের সঞ্চার করছে।

Chopra Assault Case

—ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০২৪ ০৮:৪১
Share: Save:

চোপড়ার বাহুবলী তাজিমুল ওরফে জেসিবি কি এই পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে ব্যতিক্রমী চরিত্র? অথবা তার সেই অনুচর, যে বন্দুক হাতে ছবি তুলে বেমালুম পোস্ট করতে পারে সোশ্যাল মিডিয়ায়? উত্তর রাজ্যবাসী জানেন। পশ্চিমবঙ্গের আনাচকানাচে এমন বহু জেসিবি বেড়ে উঠেছে। উত্তর দিনাজপুরের ঘটনায় উঠে এসেছে তৃণমূল বিধায়ক হামিদুল রহমানের নাম— দল তাঁকে শো-কজ় করেছে। এই বিধায়কও সম্ভবত ব্যতিক্রমী নন। জেসিবির মতো বাহুবলীদের পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকায় এমন আরও অনেক নেতাকেই দেখতে পাওয়া যায়। এই মুহূর্তে তাঁরা সংবাদ শিরোনামে নেই, ফারাক এটুকুই। রাজনৈতিক নেতার মদতে পুষ্ট দুষ্কৃতী এলাকায় দাপিয়ে বেড়ায়, পুলিশ তার হরেক অন্যায় দেখেও দেখতে পায় না— এ একেবারে অ্যাকশন সিনেমার চিত্রনাট্য থেকে তুলে আনা ঘটনা। সমস্যা হল, পশ্চিমবঙ্গের রঙ্গমঞ্চে এখন সেই কুনাট্যের নিরন্তর অভিনয় চলছে। প্রশ্ন হল, কেন? তার উত্তর রয়েছে রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত মনসবদারির অর্থনৈতিক রাজনীতির মডেলে (‘মনসবদারি’, সম্পাদকীয়, ৪-৭)। শাসক দলের যে নেতার দখলে যেটুকু জায়গা রয়েছে, সেখান থেকে খাজনা আদায় করাই এখন রাজনীতির প্রধানতম অর্জন। খাজনা তুলতে যেমন অঞ্চলের অর্থনৈতিক সম্পদের উপর নিরঙ্কুশ দখল প্রয়োজন হয়, তেমনই দরকার ত্রাসের রাজত্বেরও। ঘি তোলার জন্য নেতা যে আদৌ সোজা আঙুল ব্যবহারই করেন না, এ কথাটি সাধারণ মানুষের মনে গেঁথে দেওয়া প্রয়োজন। এটা কোনও নতুন কথা নয়— জমিদারদের লেঠেল বাহিনীর কথা ভাবলেই রাজনৈতিক বাহুবলীদের প্রাসঙ্গিকতা বোঝা যাবে। সে লেঠেলের মাথায় নেতার হাত থাকে, ফলে সে আইনের ঊর্ধ্বে— পুলিশও এ কথাটি বিলক্ষণ মেনে চলে। মেজো-সেজো নেতাদের সামনেও শিরদাঁড়া নুইয়ে নুইয়ে পুলিশের আর সোজা হয়ে দাঁড়ানোর অভ্যাসটিই নেই। ফলে, জেসিবির অত্যাচারের দৃশ্যটি পুলিশ দেখতে পায়নি— দেখার অভ্যাস নেই বলেই। চোপড়ার ঘটনাটি সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে ছড়িয়ে পড়েছে বলে হইচই— নয়তো, এমনটা হয়েই থাকে।

চোপড়ার ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রী নড়েচড়ে বসেছেন। তিনি সম্ভবত টের পাচ্ছেন যে, এক দিকে খাজনা আদায় এবং অন্য দিকে ত্রাস রাজ্যের নাগরিকদের মনে বিপুল ক্ষোভের সঞ্চার করছে। বিশেষত নাগরিকদের সেই অংশটির মনে, জীবনধারণের জন্য যাঁদের প্রত্যক্ষ ভাবে সরকারি প্রকল্পের সাহায্যের প্রয়োজন নেই। সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ লোকসভা ভোটে ঘটেছে। ক্ষোভের চরিত্র নির্ধারণে মুখ্যমন্ত্রীর ভুল হয়নি। প্রশ্ন হল, তাঁর পক্ষে কি এই পরিস্থিতি পাল্টানো সম্ভব? গত এক দশকের বেশি সময়ে পশ্চিমবঙ্গে দুর্নীতির একটি গণতন্ত্রায়ন ঘটেছে— অর্থাৎ, শাসক দলের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারলে প্রত্যেকেরই দুর্নীতিতে অধিকার জন্মেছে। যার যতখানি জোর, সে ততখানি দুর্নীতি করতে পারে। অর্থাৎ, দুর্নীতির কাঠামো এখন আনুভূমিক। এটি একটি কাঠামোগত পরিবর্তন। অভিজ্ঞরা বলবেন, বাম আমলে দুর্নীতির কাঠামো ছিল উল্লম্ব— জ়োনাল কমিটি-লোকাল কমিটির পূর্বনির্ধারিত কাঠামো মেনেই দুর্নীতিও পরিচালিত হত। আশঙ্কা হয়, বর্তমানের আনুভূমিক কাঠামোয় নিজের জোরে দুর্নীতি করতে পারা শাসক দলের অধিকাংশ নেতা-কর্মীর কাছেই একটি গুরুত্বপূর্ণ আকর্ষণ। সরাসরি দুর্নীতির অধিকার কেড়ে নিলে, অথবা সেই ব্যবস্থা চালিয়ে যাওয়ার জন্য অপরিহার্য বাহুবলের উপরে প্রশাসনিক বাধানিষেধ কায়েম করলে তাঁদের মধ্যে কত জন শাসক দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকতে চাইবেন, বলা মুশকিল। এই দুর্নীতি ছাঁটতে গেলে শেষ অবধি তা পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতো হয়ে উঠতে পারে। সুতরাং, বিক্ষুব্ধ ভোটারের মন রাখতে মুখ্যমন্ত্রী কত দূর যেতে পারেন, তার সীমা সম্ভবত পূর্বনির্দিষ্ট। প্রশ্ন হল, তাঁর রাজনৈতিক কল্পনাশক্তি ব্যবহার করে মুখ্যমন্ত্রী কি নতুন কোনও পথের সন্ধান পেতে পারেন? না কি, কিছু দূর গিয়ে ঠেকে যাওয়াই তাঁর ভবিতব্য?

অন্য বিষয়গুলি:

Chopra Assault Case TMC Crime Society
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy