Advertisement
E-Paper

তোমরা ভারী বিশ্রী

এই শোরগোল হইতে যদি মূল প্রশ্নটিকে বাছিয়া লইতে হয়, তবে তাহা অধিকারভেদের প্রশ্ন।

—ফাইল চিত্র

—ফাইল চিত্র

শেষ আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৪:৫১
Share
Save

নিকৃষ্ট মানের মুদ্রা উৎকৃষ্ট মানের মুদ্রাকে বাজার হইতে সরাইয়া দেয়, ইহা ‘গ্রেশাম’স ল’ নামে সুপরিচিত। কেবল মুদ্রা নহে, নানা বিষয়েই কথাটি সত্য। যেমন, জনপরিসরের আলাপ-আলোচনা। অলীক কুনাট্য রঙ্গ কত সহজে এবং কী পরিমাণ দাপটের সহিত সুস্থ বিতর্ককে সমাজের প্রাঙ্গণ হইতে বিতাড়ন করিতে পারে, তাহা লইয়া আর নূতন করিয়া বলিবার কিছু নাই। যে কোনও প্রসঙ্গে জনসমাজের বুকে একটি বিষয় নিক্ষিপ্ত হওয়ামাত্র তাহা লইয়া ধুন্ধুমার শুরু হইয়া যায় এবং বিষয়টি যত গুরুত্বপূর্ণই হউক না কেন, অচিরেই তাহা অতি অসার এবং প্রায়শই কুৎসিত তরজায় পর্যবসিত হয়, কাহার সাধ্য সেই কলরোলে কোনও কাজের কথা বলিতে পারে। কৃষক আন্দোলন লইয়া সঙ্গীত-তারকা রিহানা, পরিবেশ-কর্মী গ্রেটা থুনবার্গ বা আমেরিকার একাধিক রাজনীতিক-সহ বিভিন্ন পর্যবেক্ষক সমাজমাধ্যমে বিক্ষুব্ধ কৃষকদের সমর্থনে— সুতরাং, মোদী সরকারের সমালোচনায়— কিছু মন্তব্যের সঙ্গে সঙ্গে দেশের বিভিন্ন মহলে যে প্রতিক্রিয়ার তুফান উঠিয়াছে, তাহাকে অতএব অপ্রত্যাশিত বলিবার কোনও উপায় নাই। তবে এই ক্ষেত্রে কুনাট্যের বাড়তি উপাদান সরবরাহ করিয়াছে দুইটি শিবির। এক, ক্রীড়া ও বিনোদনের দুনিয়া। দুই, কেন্দ্রীয় সরকার। এই দুই শিবির হইতেই ওই সমালোচকদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রত্যাঘাত কলহে সীমিত নাই, ইতিমধ্যে শাসকীয় তৎপরতা টুইটার সংস্থার সহিত স্নায়ুযুদ্ধ হইতে শুরু করিয়া সমাজমাধ্যমের অপব্যবহারের দায়ে এফআইআর অবধি গড়াইয়াছে! অন্য দিকে, তারকা-জগতের রথী-মহারথীরা যে ভাবে ‘ভারতের সম্মান’ রক্ষায় বিদেশি সমালোচকদের বিরুদ্ধে ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছেন তাহাও রীতিমতো বিতৃষ্ণার শিহরন উদ্রেক করে।

এই শোরগোল হইতে যদি মূল প্রশ্নটিকে বাছিয়া লইতে হয়, তবে তাহা অধিকারভেদের প্রশ্ন। একটি দেশের ঘটনাবলি সম্পর্কে দেশের বাহিরের কাহারও সমালোচনা করিবার অধিকার আছে কি না, সেই প্রশ্ন। ‘বিদেশি’ সমালোচকদের প্রতিবাদে ভারতের সরকারি এবং অ-সরকারি মহলে যাঁহারা অসন্তুষ্ট অথবা ক্ষিপ্ত, তাঁহাদের বক্তব্যের সারমর্ম: ভারতে কী হইবে বা হওয়া উচিত, তাহা ভারতীয়দেরই বিচার ও বিবেচনার বিষয়, সেই বিষয়ে অন্য দেশের সমালোচকদের মন্তব্য করিবার নৈতিক অধিকার নাই। স্পষ্টতই, ইহার রন্ধ্রে রন্ধ্রে নিহিত রহিয়াছে নিরাবরণ অসহিষ্ণুতা। যতক্ষণ বিদেশিরা সরকারের অনুকূলে কথা বলিতেছেন ততক্ষণ কোনও সমস্যা নাই, বরং তাহা লইয়া সরকারি ও সরকার-অনুগামীরা মহা উৎসাহে প্রচার করিয়া থাকেন। এই কৃষক আন্দোলনের প্রশ্নেই আমেরিকান প্রশাসনের মন্তব্য হইতে অনুকূল বাক্যগুলি তুলিয়া লইয়া কেন্দ্রীয় সরকারি মুখপাত্রেরা আত্মপক্ষ সমর্থনে নামিতে দ্বিধা করেন নাই। কিন্তু মন্তব্য প্রতিকূল হইলেই পবিত্র দেশপ্রেম জাগ্রত হইয়া বলিতে থাকে: বিদেশিদের কথা শুনিব না! কেবল অসহিষ্ণুতা নহে, দ্বিচারিতাও বটে।

অথচ, একটি দেশে যাহা ঘটিতেছে সেই বিষয়ে অন্য দেশের নাগরিকদের মতামত, বিশেষত সমালোচনায় আপত্তির কোনও কারণই থাকিতে পারে না। বরং, বাহিরের অভিমত বলিয়াই বিশেষ ভাবে স্বাগত। অর্থশাস্ত্রী তথা নীতিবিদ্যার দার্শনিক অ্যাডাম স্মিথ ন্যায়সম্মত সমাজ গঠনের জন্য ‘পক্ষপাতহীন পর্যবেক্ষক’ (ইমপারশিয়াল স্পেকটেটর) নামক একটি ধারণাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়াছিলেন, যে পর্যবেক্ষক সংশ্লিষ্ট সমাজের পরিসরের বাহিরে এবং তাহা হইতে দূরবর্তী বলিয়াই তাঁহার পর্যবেক্ষণ বিশেষ মূল্যবান। বাহিরে থাকিলেই যে কাহারও দৃষ্টি পক্ষপাতহীন হইবে তাহার নিশ্চয়তা নাই, কিন্তু বিভিন্ন দিক হইতে পর্যবেক্ষণের বহুত্ব যথার্থ মূল্যায়নের সম্ভাবনা বাড়াইয়া তুলিতে পারে। এই কারণেই মানবাধিকারের বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের নজরদারির ব্যবস্থা আছে। তথ্যপ্রযুক্তি ও সংবাদমাধ্যমের এমন অবাধ বিস্তারের বিশ্বে ‘দেশের ব্যাপারে কেবল দেশের লোক কথা বলিবে’— এই অবস্থানের মধ্যে হাস্যকর দুর্বলতার প্রমাণ অতি স্পষ্ট। যাঁহারা ভারত নামক রাষ্ট্র চালাইতেছেন এবং যাঁহারা ভক্তিতে বা ভয়ে বা প্রাপ্তিযোগের আকর্ষণে— সেই রাষ্ট্রচালকদের অনুগমন করিতেছেন, তাঁহারা জানেন, কৃষক আন্দোলনের মোকাবিলায় (এবং অন্যান্য বিষয়ে) তাঁহারা যাহা করিতেছেন তাহা অন্যায়। দেশের ভিতরে প্রতিবাদ করিলেই দেশদ্রোহী বলিয়া জেলে পুরিয়া বা ভয় দেখাইয়া স্তব্ধ করিবার কৌশলটি হাতে আছে, বিদেশিদের ক্ষেত্রে সেই সুবিধা নাই, ইহা জানেন বলিয়াই কি এমন বিসদৃশ প্রতিক্রিয়া?

twitter Farmers Agitation Greta Thurnberg rihanna

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।