রাহুল গান্ধী। ছবি: পিটিআই।
বঙ্কিমচন্দ্রের দেবী চৌধুরাণী উপন্যাসে গোবরার মায়ের শ্রবণশক্তি একেবারে ছিল না এমন নয়— সেই প্রবীণা “কোন কোন কথা কখন কখন শুনিতে পায়, কখন কোন কথা শুনিতে পায় না।” অতঃপর বঙ্কিমের উক্তি: “এ রকম হইলে বড় গণ্ডগোল বাধে।” লোকসভায় রাষ্ট্রপতির ভাষণের উপরে বক্তৃতা করতে গিয়ে কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গান্ধী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উদ্দেশে যে সব প্রশ্ন নিক্ষেপ করেছিলেন, তাঁর ‘জবাবি’ ভাষণে প্রধানমন্ত্রী তাদের একটিরও কোনও সদুত্তর দেননি। সমালোচনা যে একেবারেই শুনতে পাননি এমন কথা বলা যাবে না, কারণ প্রতিপক্ষের বাক্যবাণে আহত হয়ে তিনি খেদ এবং ক্ষোভ দুই-ই প্রকাশ করেছেন বিস্তর, কিন্তু বিরোধী জনপ্রতিনিধি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আদানি গোষ্ঠী তথা তার কর্ণধারের সংযোগ সম্পর্কে যে নির্দিষ্ট অভিযোগগুলি করেছিলেন এবং যে সব তথ্য জানতে চেয়েছিলেন, সেই বিষয়ে তাঁর প্রায় দেড় ঘণ্টার বক্তৃতা কার্যত সম্পূর্ণ নীরব। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে তাপ বিকিরণ করেছেন বিস্তর, কিন্তু বিন্দুমাত্র আলো দেননি। বাস্তবিকই, এ রকম হলে বড় গন্ডগোল বাধে।
রাহুল গান্ধীর প্রশ্নমালার মূল প্রতিপাদ্য একটিই: গৌতম আদানিকে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সরকার কী পরিমাণ বিশেষ সুবিধা করে দিয়েছেন? প্রশ্নটি অবশ্যই তাঁর একার নয়, কেবল প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষেরও নয়, দেশের অগণন নাগরিকই এর সদুত্তর জানতে চান। এই প্রশ্নের সঙ্গে লতায়-পাতায় জড়িয়ে আছে আরও নানা প্রশ্ন, যেমন ব্যাঙ্ক বা অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান এই শিল্পপতিকে অন্যায় সুযোগ দিয়েছে কি না, অন্য কোনও দেশের সরকারের উপর দিল্লীশ্বরেরা আদানিকে সেখানে বিনিয়োগের ছাড়পত্র দেওয়ার জন্য চাপ বা উৎসাহ দিয়েছেন কি না, তাঁর স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে সরকারি নীতিতে কোথাও কোনও পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে কি না, ইত্যাদি ইত্যাদি। এ সবই প্রশ্ন অথবা অভিযোগ, প্রমাণ নয়। কিন্তু হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট ও শেয়ার বাজারের কল্যাণে পরিস্থিতি যেখানে পৌঁছেছে, তাতে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার এবং অভিযোগের তদন্ত করার দায় যে আদানি গোষ্ঠী এবং মোদী সরকার, উভয়ের উপরেই বর্তায়, সে-কথা অস্বীকার করার কোনও উপায় কি তাঁদের আছে?
জনসমক্ষে না হোক, নিভৃত অবকাশে প্রধানমন্ত্রী দ্বিতীয় ইউপিএ আমলের ইতিহাস স্মরণ করতে পারেন। সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলিকে কী ভাবে নির্বাচনী লড়াইয়ের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিল, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কোন ভাষায় ও ভঙ্গিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন, নরেন্দ্র মোদীর অন্তত সেই সব কাহিনি ভুলে যাওয়ার কথা নয়। মনমোহন সিংহ যদি সে দিন সংসদে দাঁড়িয়ে বাঁ হাতে বুক চাপড়ে হুঙ্কার দিয়ে বলতেন যে, সকলের সব মিথ্যা অভিযোগের বিরুদ্ধে একাই লড়ে যাবেন, তবে মোদীজি ও তাঁর সতীর্থরা মুগ্ধ হতেন কি? না কি, মনমোহনের প্রতি ব্যঙ্গবিদ্রুপের বিপুল তরঙ্গ সুনামির আকার নিত? সঙ্ঘ পরিবারের বঙ্গীয় রসিকরা হয়তো-বা মনে করিয়ে দিতেন সুকুমার রায়ের পাগলা জগাইয়ের কথা। অসার অরুচিকর আত্মস্তুতি তো অনেক হল। অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখোমুখি হলেই আহত অভিমানের ফাটা রেকর্ডও বেজেই চলেছে। মহামান্য প্রধানমন্ত্রী এক বার নিজেকে একটি প্রশ্ন করতে পারেন না কি? ঘরে এবং বাইরে সর্বত্র কেন তাঁর সরকার ক্রমাগত এমন ভাবে কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অপকর্মের অভিযোগে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়বে? নিছক সুবিধাভোগী ব্যবসায়ী ও রাষ্ট্রের আঁতাঁতের অভিযোগ নয়, রাষ্ট্রযন্ত্রের যন্ত্রীর আসনে সুবিধাভোগী ব্যবসায়ীর বসে পড়ার অভিযোগ। শিল্পপতি এবং রাষ্ট্রনায়ক দু’জনেই কেন অভিযোগ খণ্ডন না করে কার্যত একই শৈলীতে আপন মহত্ত্বের বন্দনাগীতি কীর্তন করবেন? সাফ সাফ জবাব দেওয়ার সময় কি কোনও দিনই হবে না?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy