Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Death

অ-সংবেদনশীল

বহু প্রাচীন কাল থেকেই প্রায় সমস্ত সভ্যতা একটি ধারণায় বিশ্বাসী ছিল— মৃতদেহকে বিরক্ত করা যাবে না, নিশ্চিন্তে থাকার অধিকারটি এক জন মৃত মানুষেরও প্রাপ্য।

odisha train accident.

বালেশ্বরের ট্রেন দুর্ঘটনা। —ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০২৩ ০৬:৪৭
Share: Save:

মানুষটা নেই বলে কি আর কোনও সম্মানও নেই— প্রশ্নটি শুধু বালেশ্বরের দুর্ঘটনায় মৃত যাত্রীর পরিজনেরই নয়, সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরও। অধুনা ভারতে এবং পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যেও মৃতদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের যে নমুনা দেখা যাচ্ছে, তা দেখে বোধ হয় একদা পারস্পরিক সম্মান প্রদর্শন, সৌজন্যবোধের যে সমৃদ্ধ ধারা ভারতীয় সমাজ-সংস্কৃতিতে প্রবাহিত হত, দেশ এখন সেই পথ থেকে বহুলাংশে বিচ্যুত। তা সে জীবিতের ক্ষেত্রেই হোক, বা মৃত মানুষের ক্ষেত্রে। করমণ্ডলের দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে যে অজুহাতটি দেওয়া হচ্ছে, মৃতদেহের সংখ্যার আধিক্য, সেই একই কথা শোনা গিয়েছিল করোনার সময়ও। তখনও মৃতদেহগুলি আঁকশি দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া, শববাহী গাড়িতে ছুড়ে ফেলার মতো বহু অভিযোগ শোনা গিয়েছিল। বাস্তবে, যে কোনও বড় বিপর্যয়-অন্তে মৃতের সংখ্যা বাড়বে, সৎকারের চাপ বাড়বে, এটাই প্রত্যাশিত। সেই অনুযায়ী কর্মপদ্ধতি স্থির করা, প্রয়োজনে গোটা বিষয়টি সুষ্ঠু ভাবে পরিচালনা করতে আরও লোক নিয়োগ করা প্রশাসনের কর্তব্য। তার পরিবর্তে লরিতে দেহ এমন ভাবে ছুড়ে ফেলা হবে যাতে মৃতদেহের হাত-পা ভেঙে যায়— এমনটা কি কোনও সভ্য দেশে হওয়া সম্ভব?

বহু প্রাচীন কাল থেকেই প্রায় সমস্ত সভ্যতা একটি ধারণায় বিশ্বাসী ছিল— মৃতদেহকে বিরক্ত করা যাবে না, নিশ্চিন্তে থাকার অধিকারটি এক জন মৃত মানুষেরও প্রাপ্য। ভারতীয় সংবিধানও মৃত মানুষের অধিকার সুরক্ষিত করার কথা বলে। সংবিধানের ২১ ধারা অনুযায়ী, সম্মান এবং সুব্যবহার পাওয়ার অধিকার জীবিতদের সঙ্গে মৃত মানুষদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ইতিপূর্বে বিভিন্ন মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট মৃত ব্যক্তির ধর্মবিশ্বাস অনুসারে যথাযথ ভাবে শেষকৃত্য সম্পন্ন করার কথা বলেছে। অজ্ঞাতকুলশীল, দাবিদারহীন মৃতদেহের ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হওয়ার কথা নয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে মৃতদেহের সামনে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সশ্রদ্ধ, প্রণত ছবিটি প্রকাশ্যে এসেছে। একটি রাজ্যের প্রধানের এ-হেন আচরণ অত্যন্ত মূল্যবান, শিক্ষণীয়ও বটে। নাগরিকের কাছে নিঃসন্দেহে তা এক আশ্বাস বার্তা বহন করে আনে। কিন্তু একই সঙ্গে সেই আশ্বাস জোরদার ধাক্কা খায় যখন তাঁরই রাজ্যের পুলিশ উত্তর দিনাজপুরের নির্যাতিতার দেহ উদ্ধারে চরম অমানবিকতার স্বাক্ষর রাখে। প্রশাসনই যদি ‘কর্তব্য’ পালন করতে গিয়ে অ-মানবিক হয়ে ওঠে, তবে সাধারণ মানুষ কী শিখবে?

করমণ্ডল দুর্ঘটনার পর যাঁরা মৃতদেহের সংখ্যাধিক্যের অজুহাতটি তুলেছেন তাঁদের জানা প্রয়োজন, বিপুল সংখ্যক মৃতদেহ কী ভাবে সাবধানতা মেনে ও যথাযথ সম্মানের সঙ্গে সৎকার করা যায়, সেই সম্পর্কে আন্তর্জাতিক স্তরে রেড ক্রসের স্পষ্ট গাইডলাইন রয়েছে। তবে এই ক্ষেত্রে আরও একটি কথা না বললেই নয়। একটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে। বহু মানুষ প্রিয়জনকে হারিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে মৃতদেহের সঙ্গেই পরিজনদের প্রতি, সর্বোপরি ঘটনার অভিঘাতের প্রতি সংবেদনশীলতা ‘সহজাত বোধ’ থেকেই উদ্ভূত হওয়া কাম্য। যাঁরা এই অ-মানবিক কাজটির সঙ্গে জড়িত, সবার আগে তাঁদের পরিচয়— তাঁরা মানুষ। মানুষের মধ্যে যে এ জাতীয় বোধ থাকবে, এমনটাই স্বাভাবিক। সেই স্বাভাবিকত্ব ক্রমশ সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে, এই সত্য দুর্ঘটনার চেয়ে কম ভয়ঙ্কর নয়।

অন্য বিষয়গুলি:

Death Odisha Train accident
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy