Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Sreebhumi

আতঙ্কের উৎসব

যে পুজো প্রতি বছর জনজীবনে এমন ভয়ঙ্কর বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, সেই পুজো প্রতি বছর প্রশাসনের অনুমতি লাভ করে কোন মহামন্ত্রে? এমন ভয়াবহ পুজো একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হয় না কেন?

An image of Traffic Jam

—প্রতীকী চিত্র।

শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০২৩ ০৪:৩২
Share: Save:

এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, বিমানসংস্থাগুলিও যাত্রীদের বার্তা পাঠিয়ে জানাচ্ছে, ফ্লাইট ফস্কাতে না চাইলে হাতে সময় নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোন। ভিআইপি রোডের উপরে একটি পুজো বছর-বছর গোটা শহরকে নাকাল করে ছাড়ে, এই বারও তার দাপটে এক কিলোমিটার রাস্তা পেরোতে দেড় ঘণ্টা সময় লেগেছে। খবরে প্রকাশ, স্বয়ং পুলিশকর্তা নাকি ভিআইপি রোডে ঘাঁটি গেড়েছেন— কে জানে, পরিস্থিতি তেমন ঘোরালো হলে হয়তো নিজেই ট্র্যাফিক সামলাতে রাস্তায় নামবেন। যে পুজো প্রতি বছর জনজীবনে এমন ভয়ঙ্কর বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, সেই পুজো প্রতি বছর প্রশাসনের অনুমতি লাভ করে কোন মহামন্ত্রে? এমন ভয়াবহ পুজো একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হয় না কেন? অবশ্য শুধু ভিআইপি রোড নয়, শহরের আরও অনেক রাস্তা-পাড়া-লোকালয় এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেই চলেছে। দুর্গাপুজো বস্তুটির মধ্যে এক অনাবিল আনন্দ ছিল, সাম্প্রতিক বারোয়ারির অত্যাচারে কলকাতাবাসী সে কথা ভুলতে বাধ্য হয়েছেন। রাস্তায় বেরোলে ট্র্যাফিক জ্যামের খপ্পরে পড়তে হবে, তা তো অনেক পরের কথা— বহু শহরবাসীর কাছে নিজের বাড়িতে ঢোকা-বেরোনোই এক দুঃসাহসিক অভিযানে পরিণত হয় এই সময়। তিন মাস ধরে রাস্তা বন্ধ করে মণ্ডপ নির্মাণের কাজ চলে; পুজোর সপ্তাহ তিনেক আগেই ব্যারিকেডে-ব্যারিকেডে পরিচিত লোকালয়ও পরিণত হয় গোলকধাঁধায়। তিন-চার তলা উঁচু হোর্ডিংয়ে ঢাকা পড়ে যায় বাড়ির জানলা-বারান্দা— কার্যত শ্বাস নেওয়ারও উপায় থাকে না। এ বছর তো মহালয়া থেকেই পুজো আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। সারা রাত তারস্বরে মাইক বাজে— ‘আগত দর্শনার্থী’-দের স্বাগত জানানোর সঙ্গে সঙ্গে সেই মাইক উগরে দিতে থাকে হরেক বিজ্ঞাপন। পুজোর উদ্যোক্তারা স্থানীয় বাসিন্দাদের রাতের ঘুম বিক্রি করে ঘরে টাকা তুলেছেন। অনেকের কাছেই পুজো এখন এক নির্বিকল্প, সুতীব্র আতঙ্ক— এখন তার মেয়াদ অন্তত পক্ষকাল।

গোটা ঘটনাটিই অতি প্রকাশ্য, তার মধ্যে গোপন কিছু নেই। ফলে, বছরের পর বছর এই একই ছবি যদি প্রশাসনের চোখে না পড়ে, তবে তার দৃষ্টিশক্তি নিয়ে আশঙ্কার বিস্তর কারণ রয়েছে। আর প্রশাসন যদি এই বিশৃঙ্খলা দেখেও না-দেখার ভান করে থাকে, তা হলে প্রশ্ন করা প্রয়োজন— নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্যের ন্যূনতম শর্তটুকুও যে প্রশাসন পূরণ করতে পারে না, তার থাকার প্রয়োজন কী? জনজীবন এতখানি ব্যাহত করে যে সব পুজো হয়, প্রতি বছরই সেগুলির জন্য অনুমতি মেলে কী ভাবে? পুজোমণ্ডপের কাছাকাছি কোনও বাড়িতে কেউ অসুস্থ হলে অ্যাম্বুল্যান্স ঢোকার পথটুকুও থাকে না, এই অবস্থায় নাগরিককে বাঁচতে বাধ্য করার কোনও অধিকার প্রশাসনের আছে কি? ‘জনগণের আবেগ’ জাতীয় কুযুক্তি দিয়ে এই অপদার্থতাকে আড়াল করা চলে না। উৎসব যাতে সাধারণ মানুষের জীবনকে অসহনীয় করে না তোলে, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব প্রশাসন কোনও ভাবেই অস্বীকার করতে পারে না।

গত কয়েক দশক ধরেই কলকাতার বারোয়ারি পুজোর মূল চালিকাশক্তি হল শারদীয় পুরস্কার। অস্বীকার করা চলে না যে, পুরস্কারের দৌলতেই পুজোর অনেক রকম উন্নতি ঘটেছে। কোনও পুজোকে পুরস্কারের জন্য বিবেচনা করার সময় সেই পুজোর নেতিবাচক দিকগুলিও কি বিবেচনা করার প্রয়োজন নেই? রাস্তা বন্ধ করে, জনজীবন স্তব্ধ করে দিয়ে যে পুজোগুলি হয়, সেগুলি কি আদৌ পুরস্কারের যোগ্য? এমন নয় যে, কোন পুজো কতখানি বিঘ্ন ঘটাচ্ছে তা বোঝার জন্য গোয়েন্দা নিয়োগ করতে হবে। পুরস্কারদাতারা নিজেদের সামাজিক দায়বদ্ধতার কথাটি বিস্মৃত না হলেই যথেষ্ট। অবশ্য, সেই দায়বদ্ধতা সাধারণ মানুষেরও থাকার কথা। পুজোয় আনন্দ করতে বেরোনো মানেই আর সকলের সব অসুবিধার কথা ভুলে যেতে হবে, এমন অসংবেদনশীল মানসিকতা পরিত্যাজ্য। উৎসব যখন সবার, তখন সবার ভাল থাকা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সবাইকেই নিতে হবে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy