রাজ্যের সরকারি হাসপাতালের আরও গভীর এবং গুরুতর একটি অসুখের ছবি ‘রেফার’। প্রতীকী ছবি।
যে ঘটনার ক্ষেত্রে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং অ্যাম্বুল্যান্স চালকদের অমানবিকতার বিষয়টিই প্রাথমিক ভাবে প্রকট হয়ে উঠেছিল, সেই ঘটনারই কার্যকারণ অনুসন্ধানে অবশেষে বেরিয়ে পড়ল রাজ্যের সরকারি হাসপাতালের আরও গভীর এবং গুরুতর একটি অসুখের ছবি— রেফার। শিশুটির বাড়ির সবচেয়ে কাছের হাসপাতাল রায়গঞ্জ মেডিক্যালে চিকিৎসা পরিকাঠামো থাকা সত্ত্বেও তারা শিশুটিকে ২০০ কিলোমিটার দূরের উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে ‘রেফার’ করে দেওয়ায় এত দূরে যাওয়া, শিশুটির মৃত্যু এবং শেষ পর্যন্ত অ্যাম্বুল্যান্স চালকদের অসহযোগিতার কারণে মৃত শিশুর দেহ ব্যাগে ভরে ফেরা— এই ভয়ঙ্কর ঘটনাপরম্পরা জন্ম নিয়েছে। বস্তুত, সারা রাজ্যে প্রায়শই গ্রামীণ ও জেলা স্তরের হাসপাতালগুলির ‘রেফার’-এর কারণে অসংখ্য মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা সামনে এলেও, এবং স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী বিভিন্ন সময় এর বিরুদ্ধে কড়া দাওয়াই প্রয়োগের কথা বললেও, মূল রোগটি যে অবিকৃত থেকে গিয়েছে, ফের তা স্পষ্ট হল।
শিশুটির বাড়ির অপেক্ষাকৃত কাছে মালদহ মেডিক্যাল এবং দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা হাসপাতালে এই ‘ওরাল ক্যান্ডিডা ইনফেকশন’-এর চিকিৎসার পরিকাঠামো ছিল। তৎসত্ত্বেও অত দূরে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ল কেন? এর উত্তরে বলা যায়, চিকিৎসার জন্য কোন হাসপাতালকে রোগীর পরিবার বেছে নেবে, তা সব সময় প্রয়োজনের উপর নির্ভর করে না। এখানে ভরসারও একটি বিশেষ ভূমিকা আছে। হাসপাতালের পরিবেশ, পর্যাপ্ত সংখ্যক চিকিৎসক, শয্যার সংখ্যা, উন্নত মানের যন্ত্রপাতি প্রভৃতির উপর নির্ভর করে ভরসাস্থলটি গড়ে ওঠে। ক্ষমতায় আসার পর প্রতি জেলায় সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই প্রতিশ্রুতি পালন হয়েছে। কিন্তু নামে সুপার স্পেশালিটি হলেও অনেক হাসপাতালেই তদনুযায়ী পরিকাঠামো গড়ে ওঠেনি। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাব, অকেজো যন্ত্রপাতি, টেকনিশিয়ান-এর অপ্রতুলতা— হরেক অভিযোগ। সাধারণ ব্লক বা জেলা হাসপাতালের অবস্থা সহজে অনুমেয়। সুতরাং, জেলা স্তরে আধুনিক পরিষেবা প্রদানের আশ্বাস এবং বাস্তব চিত্র— দুইয়ের মধ্যে ফাঁকটি থেকেই গিয়েছে।
হাসপাতালে কোনও বিশেষ রোগের চিকিৎসা-পরিকাঠামো থাকা সত্ত্বেও যদি ‘রেফার’ হয়, তবে সেই সুবিধা থাকার অর্থ কী? নির্বিচারে রেফার ইতিপূর্বে বহু প্রাণ নিয়েছে। সেই কারণেই অকারণ রেফার বন্ধ করতে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের শাস্তির নিদানও দেওয়া হয়েছিল। অথচ, শুধুমাত্র জটিল অসুখের ক্ষেত্রেই নয়, সাপে কাটা অথবা জ্বরের চিকিৎসাতেও ‘রেফার’ প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এত অর্থ ব্যয় করেও কেন গ্রামীণ বা জেলার স্বাস্থ্য-পরিকাঠামোকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলা গেল না, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা প্রয়োজন বইকি। বস্তুত, প্রশাসনের পক্ষ থেকে বার বার স্বাস্থ্য-পরিষেবায় প্রভূত উন্নতির প্রসঙ্গে হামেশাই জেলা স্তরে সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজের গড়ে ওঠার বিষয়টি টানা হয়। মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন, স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে পরিষেবার আমূল পরিবর্তন না হলে এবং ‘রেফার’ রোগ না কমলে সংখ্যাবৃদ্ধি কিছুই প্রমাণ করে না। হাসপাতালের সুন্দর তোরণের পরিবর্তে যথাসময়ে প্রয়োজনীয় পরিষেবা পাওয়া অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy