সভ্যতা কাকে বলে, তা নিয়ে তর্কের শেষ নেই। তবে কিনা, কেউ আমাকে বা আমার স্বজনবান্ধবকে অপমান করল, আর আমি রেগে গিয়ে তার গালে সপাটে চড় কষিয়ে এলাম— এমন আচরণ সভ্যতার কোনও মাপকাঠিতেই গ্রাহ্য হবে না। অস্কার অনুষ্ঠানে উইল স্মিথ যা করেছেন, তা যে সভ্যতার ন্যূনতম শর্ত লঙ্ঘন করে, সেটা সম্ভবত তিনি নিজেও বুঝেছেন, এমন আচরণের জন্য ক্ষমা চাইতে দেরি করেননি। কাছে এবং দূরে যাঁরা এই ঘটনায় ‘উদ্বুদ্ধ’ হয়ে জানিয়েছেন যে, এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে তাঁরাও উইল স্মিথের মতোই হাত চালাতে দ্বিধা করবেন না, আশা করা যায় তাঁরাও হাত চালানোর পরে ক্ষমা চাইবেন। প্রসঙ্গত, হলিউডের কৃতী চিত্রতারকা তাঁর ক্ষমাপ্রার্থনার সূত্রে মন্তব্য করেছেন, তিনি মানুষ হিসাবে ‘তৈরি হয়ে উঠছেন’, অর্থাৎ সম্পূর্ণ হয়ে ওঠেননি। এটাই লাখ কথার এক কথা। তিনি একা নন, সব মানুষই আসলে তৈরি হয়ে উঠছে, প্রতিনিয়ত নানা ভুলভ্রান্তি এবং মেরামতি যে নিরন্তর নির্মাণের অঙ্গ। এই গোড়ার কথাটা মনে রাখলে অনেকের অনেক অন্যায় আচরণকে গলার জোরে অস্বীকার করার দরকার হয় না, বরং নিজেকে শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করা যায়। এমনকি, একটি ভুলের মানুষী দুর্বলতার কথা ভাবতে গিয়ে প্রচলিত চিন্তাভাবনার নানা অসঙ্গতির উপরে নতুন আলো পড়তে পারে। যেমন, স্ত্রীর অমর্যাদায় উইল স্মিথের তীব্র প্রতিক্রিয়ায় যে মানসিকতার প্রতিফলন, তার পিতৃতান্ত্রিক মাত্রাটিও অনেকের চোখেই স্পষ্ট হয়েছে। সেই পিতৃতন্ত্র যেতেও কাটে আসতেও কাটে: নারী নিজের অপমানের জবাব দেবেন না, পুরুষ সেই জবাব দিতে চড় কষিয়ে আসবেন! সেই ‘শিভালরি’ সমানে চলবে? এই প্রশ্নগুলো যে উঠেছে, সেটা অবশ্যই সভ্যতার জঙ্গমতাকে চিনিয়ে দেয়।
এবং সেই জঙ্গমতার কারণেই অনিবার্য প্রশ্ন ওঠে: রসিকতার নামে মানুষকে অপমান করার অধিকার কোনও সভ্যতা কাউকে দিতে পারে কি? উইল স্মিথের প্রতিক্রিয়া নিয়ে হাজার তর্ক চলুক, কিন্তু এ নিয়ে কোনও তর্ক থাকতে পারে না যে, তার পশ্চাদ্বর্তী ক্রিয়াটি কেবল অসঙ্গত ও অশোভন ছিল না, ছিল কদর্য এবং অশ্লীল। যাঁর শারীরিক রূপ সম্পর্কে ‘রসিকতা’, তিনি এক ধরনের ব্যাধির শিকার, এই কারণে ব্যঙ্গের কুৎসিত চেহারাটি দুনিয়ার যে কোনও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে বিশেষ ভাবে স্তম্ভিত ও ক্ষুব্ধ করেছে। কিন্তু সেই প্রসঙ্গটি যদি সরিয়ে রাখা হয়, তা হলেও এই বিদ্রুপের অ-সভ্যতা তিলমাত্র কমে না। এটা খুব বড় উদ্বেগের কারণ যে, এই ধরনের ব্যক্তিগত আক্রমণের রীতি আজও প্রবল, বস্তুত সমাজমাধ্যমে এবং বিনোদনের দুনিয়ায় তার প্রাবল্য আগের তুলনায় বেড়েছে। তার পিছনে বাণিজ্যের অনুপ্রেরণা কম নয়— অশালীন বা অশোভন আক্রমণের দৃশ্য সহজেই বহুজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, প্রযুক্তির কল্যাণে তা চোখের পলকে ‘ভাইরাল’ হয়, তার ফলে ক্ষমতাবান কারবারিদের লাভের অঙ্ক স্ফীত হয়। লক্ষ্মীর সাধনাকে কী ভাবে কুবেরের আরাধনা গ্রাস করে, এ হয়তো তার এক নতুন এবং আধুনিক দৃষ্টান্ত। কুবেরতন্ত্রের নিজস্ব নিয়মেই অশোভন কৌতুকের মাত্রা উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে, এবং গত কাল যা অসহনীয় বলে গণ্য হত আজ তা অনায়াসে সহনীয় হয়ে পড়ছে।
এই প্রবণতার সঙ্গে যথার্থ সংস্কৃতির গতিপ্রকৃতির প্রত্যক্ষ বিরোধ আছে। শালীন ও সঙ্গত কৌতুকের সীমারেখা কালক্রমে পাল্টেছে, সভ্যতা এবং সংস্কৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই পাল্টেছে। দুনিয়ার সর্বত্র পাল্টেছে। ভারতীয় তথা বঙ্গীয় সমাজেই অতীতে ব্যক্তির রূপ, স্বভাব, জাতি, ধর্ম, ভাষা ইত্যাদি নিয়ে যে ধরনের রসিকতা প্রচলিত ছিল, এমনকি বরেণ্য লেখকরাও যে সব বিষয় নিয়ে রঙ্গকৌতুক করেছেন, আজ আর তাদের অনেক কিছুই শোভন বলে বিবেচিত হবে না, বস্তুত অনেক রসিকতায় আজ আর শ্রোতা বা পাঠকের হাসি পাবে না। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, সব হাসি পেলেও হাসতে নেই, নিজেকে তিরস্কার এবং সংশোধন করতে হয়, সমাজ এটাই বিবর্তনের মধ্য দিয়ে শিখছে, শিখে চলেছে। ব্যক্তিগত পরিসরকে সম্মান করার শিক্ষা তার আবশ্যিক শর্ত। অস্কার অনুষ্ঠানের মঞ্চে ক্রিস রক সেই শর্ত উৎকট ভাবে লঙ্ঘন করেছেন। তিনি কেবল এক ব্যক্তিকে অপমান করেননি, অপমান করেছেন সভ্যতার মৌলিক ধারণাকেই। উইল স্মিথের হিংস্র আচরণ অবশ্যই নিন্দনীয়। কিন্তু মুখের কথা বা ব্যঙ্গের হাসিও যে কতখানি হিংস্র হতে পারে, ক্রিস রক-এর আচরণ সেই সত্যটি আরও এক বার চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল।
যৎকিঞ্চিৎ
নতুন কর্মসূচি ‘পাহারায় পাবলিক’। ছন্দসাযুজ্য বলছে, জটায়ুর ‘সাহারায় শিহরণ’ থেকে টুকে দিয়েছে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট। কেউ অবশ্য বলতেই পারে: না, প্রকৃত অনুপ্রেরণা এসেছে ‘দুয়ারে সরকার’ আর ‘পাড়ায় সমাধান’ থেকে। এটা ঠিক যে, টুকলিতে ইদানীং বেশ দড় হয়েছে দল— ভোটের আগেও ‘টুম্পা সোনা’ ইত্যাদি টুকতে দেখা গেল। রাশিয়া থেকে বিপ্লব টুকতে পারা যায়নি, চিন থেকে পুঁজিবাদও টুকে ওঠা হয়নি ঠিকঠাক। তবে কি লোকাল টুকলিই পথ দেখাবে গ্লোবাল-কে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy