Advertisement
E-Paper

‘বিনে স্বদেশী ভাষা’

নিজের সাংস্কৃতিক পরম্পরায় স্থিত থাকিয়া বিশ্বের সংস্কৃতিকে গ্রহণ করিবার উদারতাতেই বাঙালি বিশিষ্টতা লাভ করিবে।

শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০২১ ০৫:৫৬
Share
Save

বাণিজ্যে কেবল লক্ষ্মীই বাস করেন না, ভাষা-সরস্বতীও বাস করেন। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি এই দেশে বাণিজ্য করিতে আসিয়াই বুঝিল, এই দেশের প্রধান ভাষাসমূহ শিক্ষা করিতে হইবে। দেশজ ভাষা না জানিলে বাণিজ্য বিস্তার অসম্ভব। অগত্যা সাহেবরা প্রধান ভারতীয় ভাষাগুলির মধ্যে অন্যতম ভাষা হিসাবে বাংলা শিখিতে বসিলেন। ভারতে আসিবার পূর্বেই কেহ কেহ ভারতীয় ভাষা রপ্ত করিতেন। পরে এই দেশেও সাহেবদের জন্য ভাষাশিক্ষার কলেজ গড়িয়া উঠিল। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে উইলিয়াম কেরির অধ্যক্ষতায় সাহেবদের বাংলা শিক্ষার সূত্রপাত। তবে, বাণিজ্যলক্ষ্মী সাহেবদের হস্তগত হইতেই সাহেবদের মধ্যে যাঁহারা ‘অ্যাংলিসিস্ট’, তাঁহারা ইংরেজি ভাষার গুণকীর্তন করিতে বসিলেন। ভারতীয়দের কাছ হইতে কিছু শিখিবার প্রয়োজন, এই কথা তাঁহারা বিশ্বাসই করিতেন না। মেকলে আদি সাহেবরা মনে করিতেন, ভারতে ইংরেজ আগমনপূর্বে যে বিদ্যাচর্চা হইয়াছে, তাহা ইউরোপের যে কোনও বৃহৎ গ্রন্থাগারের দুই-তিনটি থাকেই ধরিয়া যাইবে। মেকলের ব্যবস্থা নির্মিত কলে-ছাঁটা বাদামি ভারতীয় সাহেবরাও তাহাই মনে করিতেন, ফলে বাংলা ভাষার আদর কমিল। এই মনোভাবের বিরোধিতা করিয়া এক দল বঙ্গজ জাগিয়া উঠিলেন। তাঁহারা কেহই কূপবর্তী ব্যাঙের স্বভাব-সম্পন্ন ছিলেন না। এক দিকে যেমন দেশজ ভাষার প্রতি তাঁহাদের অধিকার ও ভালবাসা প্রবল, সেই প্রকারই তাঁহারা আন্তর্জাতিক চিন্তা-ভাবনায় উৎসুক ছিলেন। রামমোহন রায় বঙ্গভাষায় গদ্য রচনা করিয়া সমাজ-সংস্কার করিলেন, আবার তিনি ফরাসি দেশের রাজনীতির খবরে কান পাতিয়া রাখিলেন। সেই দেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হইলে তাঁহার আনন্দের সীমা রহিল না। এই ধারারই উত্তরসূরি বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ— স্বদেশি ভাষার প্রতি প্রীতি ও আন্তর্জাতিকতার প্রতি আগ্রহ দুইয়ের সমবায়ে তাঁহারা বঙ্গ-সংস্কৃতির নবনির্মাণ ঘটাইলেন।

অবশ্য বঙ্গভাষার অধিকার লইয়া সামান্য কৌতুক করিতেও তাঁহারা দ্বিধা করিতেন না। রামমোহন রায় পরশুরামের পূর্বেই ইংরেজিতে উলটপুরাণ রচিয়াছিলেন। সেই উলটপুরাণে আছে, বাংলা ভাষা নিঃসন্দেহে ইংরেজি ভাষার চাহিতে উত্তম। ইংরেজি ভাষা বহু-ভাষার উপাদানে খিচুড়ি। বাংলা সংস্কৃত-নিঃসৃত পরিশুদ্ধ বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষা। সুতরাং, ভারতবর্ষীয় ইংরেজদের অবশ্যকর্তব্য ইংরেজি পরিত্যাগ করিয়া তাঁহাদের ভাষা হিসাবে বাংলাকে গ্রহণ করা। সন্দেহ নাই যে, রামমোহন তাঁহার এই যুক্তি প্রাচ্যবিদ, ভারতে এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম জোন্সের বক্তব্যের আদলে বিন্যস্ত করিয়াছিলেন। জোন্স বাংলা ভাষাকে ভাল ভাষা বলিয়া মনে করিতেন না— সংস্কৃত ভাষাকে তিনি লাটিন ও গ্রিকের চাইতেও অনুকরণযোগ্য ধ্রুপদী ভাষা বলিয়া স্বীকার করিতেন। পরবর্তী কালে উইলিয়াম কেরি তাঁহার বাংলা ভাষার অভিধানের ভূমিকায় বাংলাকে সংস্কৃত-নিঃসৃত বিশুদ্ধ ভাষা বলিয়া প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। এই যুক্তিক্রম রামমোহনের উলটপুরাণের ভিত্তি। পরশুরাম রসিক চূড়ামণি। তিনি কঠিন তত্ত্বকথা না লিখিয়া সরস গল্পে সাহেবদের বাংলা ভাষা গ্রহণের বিবরণ দিলেন। ভাষায় ভাষায় আধিপত্যের লড়াই এই সরস উলটপুরাণ রচনার নিহিত কারণ।

ভাষার সহিত ভাষার দ্বন্দ্ব মিটাইবার নানা প্রয়াস এখন চালু। নিজের ভাষাজ্ঞান বজায় রাখিয়া অন্য ভাষা শিক্ষা ও প্রয়োগের সংস্কৃতি মান্য সংস্কৃতি। মানব ভাষা মাত্রেই গুরুত্বপূর্ণ। মানব ভাষার মধ্যে যে অসংখ্য বাক্য সৃষ্টির সামর্থ্য রহিয়াছে তাহা যে কোনও বিশেষ ভাষার পক্ষেই সত্য। তাই মানব ভাষা মাত্রেই ভাল ভাষা। নানা কারণে কোনও এক ভাষার অন্য ভাষার চাহিতে বিস্তার লাভ ঘটিয়া থাকে। প্রযুক্তিগত কারণ, অর্থনৈতিক কারণ, সাংস্কৃতিক কারণ ইত্যাদির সূত্রে এক ভাষা আর এক ভাষার চাহিতে অগ্রসর হয়। তাহা ছাড়া ভাষীর সংখ্যার উপরেও ভাষার গুরুত্ব নির্ভর করে। ইংরেজি বর্ষের এই শেষবেলায় খবরে প্রকাশ বাংলা ইংল্যান্ডে দ্বিতীয় প্রধান ভাষার গুরুত্ব পাইয়াছে। সেই দেশে ভারতবর্ষীয় ও বাংলাদেশীয় বাঙালিদের সরব উপস্থিতিই ইহার কারণ। ঔপনিবেশিক পর্বের ভাষা-আধিপত্যের রাজনৈতিকতার সূত্রে ইহাকে বাংলা ভাষার জয় হিসাবে ভাবিবার প্রয়োজন নাই। কেবল বাঙালি হইয়া থাকিলে কিংবা অল্প লইয়া থাকিলে বাঙালি সংস্কৃতি সবল হইবে না। নিজের সাংস্কৃতিক পরম্পরায় স্থিত থাকিয়া বিশ্বের সংস্কৃতিকে গ্রহণ করিবার উদারতাতেই বাঙালি বিশিষ্টতা লাভ করিবে। লন্ডন নগরীর খবর তাহারই প্রমাণ।

যৎকিঞ্চিৎ

ইংরেজিতে যা ‘হার্ড নাট টু ক্র্যাক’, উত্তরপ্রদেশে তা-ই ‘হার্ড কোকোনাট টু ক্র্যাক’। নতুন রাস্তা উদ্বোধনে বিধায়ক রাস্তায় নারকেল ঠুকে ভাঙতে গেলেন, নারকেল তো ভাঙলই না, নতুন রাস্তাটা গেল ভেঙে! নারকেলের বিশেষত্ব তো বটেই, নতুন রাস্তার গুণের পরিচয়ও বটে। বিধায়ক নিজেই ধর্নায় বসলেন। কেউ বলছেন, ওই নারকেল কারও মাথায় পড়েনি ভাগ্যিস! কেউ বলছেন, দোষ কারও নয় গো মা— ভোট পাওয়ার এই আদি-অন্তহীন আদিখ্যেতা— করে দিয়ো ক্ষমা!

language

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।