Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪
Satyajit Ray

স্মরণীয়, প্রাসঙ্গিক

আধুনিক ভারত নির্মাণে অগ্রসর হইবার জন্য যে গভীর এবং প্রবল প্রত্যয়ের প্রয়োজন ছিল, নেহরুর ভান্ডারে তাহার অভাব হয় নাই।

শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০২১ ০৬:৪১
Share: Save:

ভারতের স্বাধীনতার পূর্বাহ্ণে একটি বক্তৃতায় জওহরলাল নেহরু বলিয়াছিলেন, দেশের সম্মুখে বহুবিধ সমস্যা রহিয়াছে, যথা ক্ষুধা ও দারিদ্র, অপরিচ্ছন্নতা ও নিরক্ষরতা, বিবিধ কুসংস্কার তথা মারাত্মক সব রীতি ও প্রথা, বিপুল সম্পদের অপচয়, ঐশ্বর্যবান দেশে বুভুক্ষু জনতার বসতি; এবং বিজ্ঞান, ‘একমাত্র বিজ্ঞান’ই এই সমস্যাগুলির সমাধান করিতে পারে। তাঁহার এই কথাটি বহু প্রসঙ্গে বহু বার উদ্ধৃত হইয়াছে, কিন্তু এই বক্তব্যের তাৎপর্য সম্পর্কে নূতন করিয়া ভাবিবার অবকাশ আছে, প্রয়োজনও আছে। কে ভাবিবে? আপন অশিক্ষার অহমিকা এবং ক্ষুদ্র স্বার্থবুদ্ধির কুমন্ত্রণায় নেহরুর প্রতি ব্যঙ্গবিদ্রুপ অথবা বিষোদ্গার করিয়া চলেন, অধুনা রাষ্ট্রশক্তির বরে যাঁহাদের আস্ফালন কুৎসিত আকার ধারণ করিয়াছে, তাঁহারা ভাবিবেন না, কারণ তাঁহাদের ভাবিবার সাধ নাই, সাধ্যও নাই। অন্য দিকে, ভাবিবেন না তাঁহারাও, যাঁহারা নেহরুকে মহামানবের আসনে বসাইয়া সন্তুষ্ট এবং কৃতার্থ, আজ তাঁহার জন্মদিবসে যাঁহাদের কণ্ঠে ভক্তির বান ডাকিবে, যে বানের জল শর্বরী পোহাইবার পূর্বেই সরিয়া যাইবে। কিন্তু ভক্ত এবং বিদ্বেষীর বাহিরে যে নাগরিকদের সুচিন্তার শক্তি এখনও জাগ্রত, তাঁহারা ভাবিতে পারেন। নেহরুর স্বার্থে নহে, দেশের স্বার্থে, সমাজের স্বার্থে, আপন স্বার্থে। দেশের অর্থনীতি ও সমাজের অগ্রগতিতে বিজ্ঞানের যে ভূমিকার কথা তিনি বলিয়াছিলেন, এই একটি বক্তৃতায় নহে, কার্যত সারা জীবন অক্লান্ত ভাবে বলিয়াছিলেন, প্রধানমন্ত্রী হিসাবে রাষ্ট্রনীতিতে যে ভূমিকাকে কার্যকর করিতে বিস্তর চেষ্টা করিয়াছিলেন, আজও তাহার গুরুত্ব কিছুমাত্র কম নহে। বস্তুত, সেই গুরুত্ব এখন আরও অনেক বেশি, কারণ বিজ্ঞান সম্পর্কে বর্তমান শাসকদের অজ্ঞতা এবং বহু ক্ষেত্রেই বিরূপতা প্রবল, তাহার প্রতিষেধক হিসাবে নেহরুর বিজ্ঞানমনস্কতা বিশেষ ভাবে স্মরণীয়।

এই বিজ্ঞানমনস্কতার দুইটি দিক আছে, উপরোক্ত উদ্ধৃতিটি বিচার করিলে যাহা সহজেই অনুধাবন করা যায়। একটি দিক বিজ্ঞানের প্রয়োগ সম্পর্কিত: বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার করিতে পারিলে অর্থনীতি ও সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নে গতি আসিবে, কৃষির ফলন ও শিল্পের উৎপাদন বাড়িবে, শিক্ষায় স্বাস্থ্যে উন্নতি সাধিত হইবে, জাতীয় সম্পদের কুশলী ব্যবহারের মাধ্যমে ক্ষুধা ও দারিদ্র দূর হইবে, যথাযথ নীতির সাহায্যে অসাম্য দূর করা সহজতর হইবে। স্বাধীনতার পরে ভারতে বিজ্ঞান গবেষণা, প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং শিল্পায়নে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির প্রয়োগের যে বিপুল উদ্যোগ গোটা দুনিয়ার সমীহ আদায় করিয়াছিল, দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী যে তাহার প্রধান চালিকাশক্তি ছিলেন, তাহা এমনকি নরেন্দ্র মোদীরও অজ্ঞাত নহে। শিক্ষায় এবং শিল্পে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রশ্নে নেহরুকে কেবল গাঁধীজির সহিত মৌলিক মতানৈক্যের মোকাবিলা করিতে হয় নাই, তাঁহার সহকর্মীদের মহলেও এই বিষয়ে বিস্তর আপত্তি ও সংশয় ছিল। সেই বাধা অতিক্রম করিয়া আধুনিক ভারত নির্মাণে অগ্রসর হইবার জন্য যে গভীর এবং প্রবল প্রত্যয়ের প্রয়োজন ছিল, নেহরুর ভান্ডারে তাহার অভাব হয় নাই। তাহা ভারতের পক্ষে পরম সৌভাগ্যের।

কিন্তু এই প্রত্যয় কেবল বিজ্ঞানের ব্যবহারিক উপযোগিতার ধারণা হইতে আসে নাই, তাহার পিছনে ছিল নেহরুর বিজ্ঞানমনস্কতার দ্বিতীয় এবং গভীরতর মাত্রাটি। ১৯৫০ সালে এক ভাষণে তিনি, কিঞ্চিৎ তীব্র উচ্চারণে, মন্তব্য করিয়াছিলেন, “বিজ্ঞানের কথা বলিবার সময় অধিকাংশ লোক, এবং আমাদের শিল্পপতিরাও, বিজ্ঞানকে নিছক অনুচর বলিয়া মনে করে, যে (আমাদের) কাজটিকে সহজ করিয়া দেয়।... বিজ্ঞান তাহা করে বটে, কিন্তু বিজ্ঞান আরও অনেক কিছু করে।” কী সেই ‘আরও অনেক কিছু’? তাঁহার বহুচর্চিত ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া গ্রন্থের ভাষায় বলিলে— “তাহা হইল বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি, বিজ্ঞানের মানসিকতা— যাহা দুঃসাহসী অথচ সংশয়ী, সত্য এবং নূতন জ্ঞানের অন্বেষা, পরীক্ষানিরীক্ষা ব্যতিরেকে কোনও কিছু গ্রহণ করিতে আপত্তি... ইহাই হওয়া উচিত জীবনের ধর্ম, চিন্তার ধারা... ইহাই মুক্ত মানবের মানসিকতা।” অতঃপর তাঁহার অমোঘ খেদোক্তি: “শুনিতে পাই আমরা বিজ্ঞানের যুগে বাস করি, কিন্তু কোথায়ও জনসাধারণের মধ্যে বা এমনকি তাঁহাদের নেতাদের মধ্যেও এই মানসিকতার কোনও লক্ষণ নাই।” আরও এক বার বলিতেই হয় যে, নরেন্দ্র মোদীর ভারতে এই খেদোক্তি বহুগুণ বেশি সত্য, সুতরাং জওহরলাল নেহরুও বহুগুণ বেশি প্রাসঙ্গিক।

যৎকিঞ্চিৎ

কোস্টা রিকা। এক দিকে ক্যারিবীয় সমুদ্র, অন্য দিকে প্রশান্ত মহাসাগর, ছোট্ট ছবির মতো দেশ। শিশুদের বাধ্যতামূলক কোভিড ভ্যাকসিন নিতে হবে, কোমর বেঁধে নেমেছে তারা। শিশু বলতে পাঁচ থেকে এগারো। আর এগারোর উপরে বড় শিশুরা তো কবেই ভ্যাকসিনপ্রাপ্ত— আমেরিকার মতো বড় ধনী দেশেই হোক, আর কোস্টা রিকার মতো ছোট, তত-ধনী-নয় দেশেই হোক। ভারত? সে কেবল ঘুমায়ে রয়। জগৎসভার সব আসনই চলে গেল, এ বার তার জায়গা সভার বাইরে ওয়েটিং লিস্টে!

অন্য বিষয়গুলি:

Satyajit Ray
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy