Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Net

কারখানা নহে

গবেষণার প্রস্তাবটুকুও না দেখিয়া পিএইচ ডি-র আবেদন বিচার কী ভাবে সম্ভব, এই বার সেই অভূতপূর্ব নিরীক্ষার সাক্ষী হইবে ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থা।

শেষ আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০২১ ০৬:০৮
Share: Save:

বিদ্যাচর্চার উৎকর্ষ সাধনে যুগ-যুগ ধরিয়া যে রাস্তায় হাঁটিয়াছে বিশ্বের প্রকৃষ্ট শিক্ষাব্যবস্থা, তাহার বিপরীত পথকেই অভীষ্ট ভাবিয়াছে ভারতের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলি। ৪১টি বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈঠকে স্থির হইয়াছে, নিজস্ব প্রবেশিকা পরীক্ষা বা সাক্ষাৎকার আর নহে, ‘গোত্রহীন’ ও ‘মান্য’ সর্বভারতীয় ‘ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি টেস্ট’ (নেট) এখন হইবে পিএইচ ডি-র যোগ্যতামান নির্ণয়ের ভিত্তি। অর্থাৎ একটি কেন্দ্রীয় পরীক্ষাব্যবস্থায় মাল্টিপল চয়েস প্রশ্নের উত্তর করিয়া ছাত্রছাত্রীরা যে নম্বর পাইবেন, তাহা অনুসারেই গবেষণার জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করিতে পারিবেন। শিক্ষামহলের একাংশেরই মত, ইহাতে গবেষণার মান ও প্রতিষ্ঠানের বিদ্যাচর্চার স্বাধিকারের সহিত আপস করা হইবে, ক্ষুণ্ণ হইবে তাহার স্বকীয় বৈশিষ্ট্য এবং নানা ধরনের ছাত্রছাত্রীকে ধারণ করিবার ঐতিহ্য। বস্তুত কাহারও চিন্তার প্রবণতা ও স্ব-ক্ষমতা যাচাই না করিয়া, এমনকি গবেষণার প্রস্তাবটুকুও না দেখিয়া পিএইচ ডি-র আবেদন বিচার কী ভাবে সম্ভব, এই বার সেই অভূতপূর্ব নিরীক্ষার সাক্ষী হইবে ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থা।

সর্বভারতীয় স্তরে একটি পরীক্ষার ব্যবস্থা হইলেও তাহার ফলাফলকেই একমাত্র মাপকাঠি হিসাবে গণ্য করিলে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধিকার খণ্ডিত হয়। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের অধিকার রহিয়াছে নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী ছাত্রছাত্রী বাছিয়া লইবার। কোনও প্রতিষ্ঠান মেধাকেই সর্বাগ্রগণ্য বিবেচনা করিতে পারে, কাহারও সামাজিক ন্যায়বিধানের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকিতে পারে, কোনও প্রতিষ্ঠান আবার পরিচালিত হইতে পারে ভিন্নতর কোনও যুক্তিতে। সেই অধিকার থাকা বিধেয়। ফলে, সর্বভারতীয় পরীক্ষা যদি থাকেও, তবে তাহা বড় জোর প্রতিষ্ঠানে ভর্তির একটি মাপকাঠি হইতে পারে, একমাত্র নহে। উদাহরণ হিসাবে বলা চলে যে, আমেরিকায় পড়িতে যাইবার জন্য জিআরই পাশ করিতে হয় বটে, কিন্তু শুধু তাহার জোরে সুযোগ মিলে না। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে গবেষণা প্রস্তাব যাচাই করিবার দীর্ঘ প্রক্রিয়া আছে, ভর্তির ক্ষেত্রেও বিশ্ববিদ্যালয়-নির্দিষ্ট নিয়মাবলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কাহাকেও গ্রহণ করিবার পূর্বে গবেষণা করিবার ক্ষমতাটি বুঝিয়া না লইলে তাহার যোগ্যতা নির্ণয় অসম্ভব।

দ্বিতীয় বিপদটি অতিমাত্রায় কেন্দ্রীকরণের। দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে একই নিয়ম মানিয়া, একই ছাঁচে ফেলিয়া গবেষক-ছাত্র মনোনয়ন করা হইবে, এই দাবিটির মধ্যে একশৈলিক শৃঙ্খলাবদ্ধতার যে অনপনেয় ছাপ রহিয়াছে, তাহা নাগপুরের পাঠশালার সহিত মানানসই, মুক্ত জ্ঞানচর্চার প্রতিষ্ঠানের সহিত নহে। ইহা একটি বিশেষ মানসিক প্রবণতার প্রকাশ— যে মানসিকতা কোনও রূপ বহুত্বকে স্বীকার করিতে নারাজ। তদুপরি, এই ব্যবস্থার মধ্যে চিন্তার বৈশিষ্ট্যের কোনও স্থান নাই, মুখস্থ করিয়া উগরাইয়া দিতে পারিলেই যথেষ্ট। চিন্তার ক্ষমতাকে নষ্ট করিয়া দিতে না পারিলেও তাহাকে অবান্তর করিয়া তোলাও আসলে সেই একশৈলিক ব্যবস্থা গড়িয়া তুলিবার প্রকল্পেরই অংশ। ছাঁচে ঢালা শিক্ষাব্যবস্থা, ছাঁচে ঢালা গবেষণা— এবং, অচিরেই বোঝা যাইবে যে, সেই ছাঁচটি এক বিশেষ কারখানায়, বিশেষ মতামতের প্রসারকল্পে নির্মিত— ইহা উচ্চশিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার অভিমুখ হইতে পারে না।

অন্য বিষয়গুলি:

Net NEP
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy