ইংরেজ পণ্ডিত টেরি ইগলটন বলিয়াছিলেন, ভাষাই সকল পরিচিতির শিকড়, তাহার বিকৃতি হয় কাব্য নতুবা রাজদ্রোহ। সেই যুগ গিয়াছে, বৈয়াকরণদের ‘প্রেসক্রিপটিভিজ়ম’ বা নির্দেশমূলক ছাঁচ হইতে ভাষাবিজ্ঞানীদের ‘ডেসক্রিপটিভিজ়ম’ বা বর্ণনামূলক ছাঁচে পৌঁছাইয়াছে ভাষাবিজ্ঞানচর্চা। এই কালে ‘ইহা করিতে হইবে’ বা ‘উহা ভ্রান্ত’ ইত্যাদি মন্তব্য শুনা যায় না। এখন ভাষার বহু রূপ অধ্যয়ন করিয়া তাহার পশ্চাতের বিজ্ঞানটি অন্বেষণ করা হয়। কিন্তু, এই সকল গতিশীলতা বোধ হয় ফরাসি ভাষার প্রতিষ্ঠান ‘আকাদেমি ফ্রঁসেস’-কে স্পর্শ করিতে পারে নাই। ১৬৩৫ খ্রিস্টাব্দে রাজা ত্রয়োদশ লুইয়ের আমলে জাত কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি ফরাসি ভাষার ‘শুদ্ধতা’হরণ লইয়া গভীর চিন্তা ব্যক্ত করিয়াছেন। তাঁহাদের বক্তব্য, ‘সামাজিক মিশ্রণ’-এর ফলে ‘ভাষার অবনমন’ ঘটিতেছে, ‘শুদ্ধ ফরাসি’ রক্ষা করা যাইতেছে না। তাঁহারা সম্ভবত ভুলিয়াছেন যে, ভাষা চিরদিন বহতা নদীর ন্যায় এক আশ্চর্য অর্জন-বর্জনের খেলা, বিশ্বায়নের যুগে যাহা সর্বত্র স্বীকৃত।
বস্তুত ফ্রেঞ্চ অ্যাকাডেমি যাহা বলিয়াছে, তাহা প্রয়োগে কেবল সময়ের উল্টা পথে হাঁটিলেই চলিবে না, ভাষার স্বাভাবিক চলনও অস্বীকার করিতে হইবে। সমাজভাষাবিজ্ঞান বলে, প্রতি ক্রোশে বাতাস আর বুলি পাল্টাইয়া যায়। বিদ্যাচর্চা ও প্রশাসনের স্বার্থে তাহার একটি ‘মান্য’ চেহারা সৃষ্টি করা হয়, যদিও তাহাও অলঙ্ঘনীয় নহে। ব্যবহারিক কারণে যেমন বাংলায় ‘চেয়ার’, ‘টেবিল’, ‘আলমারি’ প্রবেশ করিয়াছে, ফরাসিতেও ঢুকিয়াছে ‘ক্লাস্টার’, ‘টেস্টিং’। ভাষা সমাজের দর্পণবিশেষ— সমাজে আধিপত্য বা মিশ্রণ যে ভাবে হইবে, তাহারই ছাপ পড়িবে সদস্যগণের ব্যবহৃত ভাষায়। এযাবৎ কাল যে ভাষা সেই নিয়ম মানে নাই, অর্থাৎ যাহাকে জনসমাজ হইতে বিচ্ছিন্ন রাখা হইয়াছে, তাহাই মৃত্যুবরণ করিয়াছে। সংস্কৃত বা ল্যাটিনের ন্যায় ধ্রুপদী ভাষার পরিণতি নিশ্চয়ই কাহারও আকাঙ্ক্ষা হইতে পারে না।
সুতরাং, ফরাসি প্রতিষ্ঠানটির মন্তব্যের পশ্চাতে রাজনীতির হিসাব এড়াইয়া গেলে ভুল হইবে। ভাষার ‘ইংরেজিদূষণ’-এ তাহারা এক বিশেষ আখ্যা ব্যবহার করিয়াছে: ‘ক্যালিফর্নিজ়ম’, যাহার অর্থ আমেরিকার পশ্চিমোপকূল-সঞ্জাত সাংস্কৃতিক আধিপত্য। ক্যালিফর্নিয়াতেই বিশ্বের অধিকাংশ বৃহৎ প্রযুক্তি সংস্থার জন্ম, ডিজিটাল যুগে তাহাদের প্রভাবও তাই সুদূরব্যাপী। যাঁহারা সেই প্রভাব এড়াইতে আপনার ভাষা-সংস্কৃতি-ধর্ম-ইতিহাসকে তালা-চাবি দিয়া সিন্দুকে তুলিয়া রাখিবার কথা বলিতেছেন, তাঁহারা শুধু সমাজবাস্তবকে অস্বীকার করিতেছেন না, একশৈলিক পরিচিতি-নির্মাণও তাঁহাদের অভিলাষ। ইদানীং ভারতও এই রাজনীতির সহিত অপরিচিত নহে, এই দেশেও অনেকে ভিন্জাতীয় চিন্তাপথের বিরোধিতা করিতেছেন। ইঁহাদের স্মরণ করাইয়া দিতে হয়, বৈদিক যুগের ভারত হউক বা সপ্তদশ শতাব্দীর ফরাসি দেশ— ভাষা-সংস্কৃতিতে ‘শুদ্ধতা’ বলিয়া কিছু হয় না, তাহা বহু যুগের স্তরীভূত সঞ্চয়ের ফল। দ্য ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া গ্রন্থে তাহা ধরাইয়া দিয়াছিলেন জওহরলাল নেহরু। তাহাকেই কবি বলিয়াছিলেন স্রোতস্বিনী নদী, অন্যথায় যাহাকে বাঁধিবে সহস্র শৈবালদাম। এই উদ্যোগকে তাই কেবল অর্থহীন ভাবিলে চলিবে না, তাহা নিশ্চিত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy