কথায় বলে— উৎসব সকলের। কিন্তু বঙ্গের উৎসব মরসুম দেখিয়া তাহা বুঝিবার উপায় নাই। এইখানে উৎসব শুধুই সবলের জন্য নির্দিষ্ট, দুর্বলের সেখানে কোনও স্থান নাই, তাহাদের কথা ভাবিবার অবকাশ কাহারও নাই। এক দল প্রবল আমোদে মত্ত হয়। অন্য দল নীরবে, প্রাণটুকু হাতে লইয়া কোনও ক্রমে বাঁচিয়া থাকে। এই দ্বিতীয় দলটির অন্তর্ভুক্ত হইবে মনুষ্যেতর প্রাণীগুলি। উৎসবের দিনগুলিতে আলো এবং বাজির ঝলকে, দূষণে তাহারা কোথায় থাকে, কেমন থাকে, সেই কথা ভাবেন কয় জন? সর্বোপরি, প্রতি বৎসর শ্যামাপূজার পূর্বে বাজির দূষণ লইয়া তবু কিছু বাক্য খরচ হয়। কিন্তু আলোর দূষণ লইয়া সেই সচেতনতার চিহ্নমাত্র দেখা যায় না। অথচ, পরিবেশবিদরা জানাইতেছেন, আলোর অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে পাখি এবং অন্য কীটপতঙ্গের ভয়ঙ্কর ক্ষতি হয়। বিপন্ন হইয়া পড়ে জীববৈচিত্র।
বিপন্নতার নিদর্শনও নানারূপ। এবং তাহা যে শুধুমাত্র উৎসবের দিনগুলিতেই আবদ্ধ থাকে, তাহা নহে। এক সময় রবীন্দ্র সরোবরের অভ্যন্তরে জোরালো আলো লাগাইবার প্রতিবাদ করিয়াছিলেন পরিবেশকর্মীরা। যুক্তি ছিল, রবীন্দ্র সরোবরের গাছগুলি অসংখ্য পাখি এবং কীটপতঙ্গের ঠিকানা। তীব্র আলোয় তাহাদের স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়াকলাপ ব্যাহত হইবে। সন্ধ্যা নামিলে পাখিরা বাসায় ফেরে, বিশ্রাম লয়। সূর্য অস্ত যাইবার পরেই গাছের চার ধারে তীব্র আলো জ্বলিয়া উঠিলে তাহারা বিভ্রান্ত হইয়া পড়ে। এই বিভ্রান্তি, বিপন্নতা আরও বৃদ্ধি পায় উৎসবের দিনগুলিতে। শহর হইতে গ্রাম সাজিয়া উঠে আলোকমালায়। প্রায়শই সেই সজ্জার জন্য বাছিয়া লওয়া হয় পথপার্শ্বের গাছগুলিকে। কখনও তাহার গায়ে বিদ্যুতের তার জড়াইয়া দেওয়া হয়, কখনও তাহার আপাদমস্তক মুড়িয়া দেওয়া হয় রঙিন আলোকে, আবার কখনও তাহার ডাল হইতে শক্তিশালী হ্যালোজেন আলো ঝুলাইয়া দেওয়া হয়। ফলে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় গাছটি, ক্ষতিগ্রস্ত হয় গাছে আশ্রয় লওয়া প্রাণীগুলিও। আলোর উত্তাপ এবং দূষণ— কোনওটিই তাহাদের পক্ষে সুখকর নহে। অথচ, আলোর আতিশয্য লইয়া পরিবেশবিদদের সতর্কবাণী মান্যতা পায় না।
একই নির্লিপ্তি শব্দদূষণ লইয়াও। দীপাবলি তো বটেই, সাম্প্রতিক কালে যে কোনও উৎসবে বাজি অথবা ডিজে বক্স ব্যবহারের যে উৎকট চল হইয়াছে, সেই দূষণে পশু, পাখিরাও অতিষ্ঠ। অথচ, পশুপ্রেমীদের বারংবার আবেদন বিফলে গিয়াছে। সরকারও পরোক্ষে এই অসভ্যতাকে প্রশ্রয় দিতেছে। আদালত উদ্যোগী না হইলে এই দুরবস্থা যে আরও বহু গুণ বৃদ্ধি পাইত, সন্দেহ নাই। প্রতি বৎসর উৎসবের মরসুমে ইহা যেন এক অসম লড়াই, বৃহৎ সংখ্যক আমোদপ্রিয় মানুষের সঙ্গে পরিবেশ-সচেতন কতিপয় মানুষের মধ্যে। এই লড়াইয়ে প্রায়শই জয়ী হয় আমোদপ্রিয়তা। অন্যরা উৎসব হইতে বহু দূরে অন্ধকারেই পড়িয়া থাকে। উৎসব আনন্দের, অবশ্যই। কিন্তু সেই আনন্দে সকলের সমান অধিকার আছে। এক জনের উৎসব অন্যের কাছে অত্যাচারে যেন পর্যবসিত না হয়, তাহা সর্বাগ্রে নিশ্চিত করিতে হইবে। তবেই তো উৎসবের সার্থকতা। এই অতি সাধারণ কথাটি বুঝাইতে কি বারংবার আদালতের শরণাপন্ন হইতে হইবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy