বঙ্গবাসীর দুর্গোৎসব হয়তো আরও দিন দুই-এক চলিবে, কিন্তু পঞ্জিকার পৃষ্ঠায় আজই উৎসবের পরিসমাপ্তি। আজ বিকালে উমা পিতৃগৃহ বাস শেষ করিয়া কৈলাসে ফিরিবেন। শহুরে বাঙালি অবশ্য অভিজ্ঞতায় শিখিয়া লইয়াছে যে, এই বৎসরের উৎসব মিটিল মানেই পরবর্তী উৎসবের প্রস্তুতি শুরু। পূজাকর্তারা শিল্পীদের ‘বুক’ করিয়া ফেলিবেন, পরের বৎসরের থিম লইয়াও ভাবনা শুরু হইয়া যাইবে। প্রকৃত প্রস্তাবে, ইহাই চলমানতার ধর্ম— প্রতিটি সমাপ্তিই আসলে পরবর্তী সূচনার মুহূর্ত। তরঙ্গ মিলাইয়া যাইবার মুহূর্তেই তো পরের তরঙ্গ উঠে, একটি কুসুম ঝরিয়া পড়িবার কালেই পরের কুসুমটি ফুটে। সমাপ্তির মুহূর্তটি যে সর্বদাই বিজয়সূচক, তাহা না-ও হইতে পারে। বহু সমাপ্তিতেই লগ্ন হইয়া থাকে পরাভব, ব্যথর্তার অবসাদ। কিন্তু, সেই মুহূর্তটিকে অতিক্রম করিয়া পরবর্তী সূচনার দিকে চাহিতে পারাই প্রকৃতির শিক্ষা। কোনও জয়ই যেমন চিরস্থায়ী নহে, তেমনই পরাজয় যতই সুতীব্র হউক, তাহার আয়ু সীমিত। সমাপ্তির লগ্নটিকে পরবর্তী সূচনার মাহেন্দ্রক্ষণ বলিয়া চিনিয়া লইতে পারিলে, যাহা ঘটিয়া গিয়াছে তাহার গৌরব বা ম্লানিমাকে অতীতে রাখিয়া ভবিষ্যতের উদ্দেশ্যে পা ফেলিতে পারিলে ভবিষ্যৎকে নূতন করিয়া লেখা সম্ভব। বিজয়ার মুহূর্তে বাঙালি এই কথাটি স্মরণে রাখিতে পারে, দেশবাসী এবং বিশ্ববাসীকে স্মরণ করাইয়া দিতে পারে।
প্রথম যে যুদ্ধটিতে আবিশ্ব মানুষ সমূহ পরাভবের সম্মুখীন, তাহা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। বিপদটি কতখানি প্রকট, তাহা বুঝিতে এখন আর কোনও রিপোর্টের অপেক্ষায় থাকিতে হয় না— বিশ্ব জুড়িয়া ঝড়, বন্যা, বিপর্যয় প্রতি মুহূর্তে এই বিপদের কথা স্মরণ করাইয়া দিতেছে। এই বিপদ মানবসভ্যতার ডাকিয়া আনা। প্রকৃতির সম্মুখে সভ্যতার মদগর্বে গর্বিত মানুষের পরাজয়ের কথা ঘোষণা করিতেছে জলবায়ু পরিবর্তনের পরিস্থিতি। কিন্তু, এখনও সময় আছে। এখনও সাবধান হইলে নীলগ্রহের ভবিষ্যৎ অন্য রকম হইতে পারে। কিন্তু তাহার জন্য অতীতের অহঙ্কার ভুলিতে হইবে, তাহা হইতে শিক্ষা লইতে হইবে। শক্তির ব্যবহার সম্বন্ধে সচেতনতা, প্লাস্টিক বর্জন, জীবনযাত্রায় পরিবর্তন— এমন বেশ কিছু কাজ করিতে পারিলে জলবায়ু পরিবর্তনের গতিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। পরিবেশ-বান্ধব প্রযুক্তির সন্ধান চালাইয়া যাইতে হইবে। কিন্তু সর্বাগ্রে প্রয়োজন অতীতের সহিত বিচ্ছিন্নতা। যে ভুল হইয়াছে, তাহাকে আর প্রলম্বিত না করিবার প্রতিজ্ঞা। অতীতকে পিছনে ফেলিয়া ভবিষ্যতের পথে হাঁটিতে পারিলে তবেই নূতন বিজয়ার সম্ভাবনা রচিত হইতে পারে।
অন্য বিপদটিও এখন কার্যত বৈশ্বিক, কিন্তু দেশে-দেশে তাহার আপাত-চেহারাটি পৃথক। সেই বিপদের নাম উগ্রতা, অসহিষ্ণুতা। দুনিয়ার ছবিটিকে ভুলিয়া যদি শুধু ভারতের দিকে তাকানো যায়, তাহা হইলেও আতঙ্কিত হইতে হয়— দেশের প্রান্তে-প্রান্তরে এখন এত রকমের অসহিষ্ণুতা, এবং তাহার ভয়াবহ প্রকাশ। এই বিপদটিকে তীব্রতর করিয়া তুলিয়াছে এক বিশেষ রাজনীতি, যাহার মূল চালিকাশক্তিই ‘অপর’-এর প্রতি বিদ্বেষ। কিন্তু, বিদ্বেষের নিকট সহিষ্ণুতার যে পরাজয় ভারত প্রত্যক্ষ করিতেছে, তাহাও কি অপরিবর্তনীয়? তাহা নহে। কিন্তু, তাহার জন্যও ভুলিতে হইবে অতীতের বৈর। সেই দায়িত্বটি প্রথমত এবং প্রধানত সংখ্যাগরিষ্ঠের। রাজনীতি যদি সেই দায় লইতে অস্বীকার করে, তবে নাগরিক সমাজকেই করিতে হইবে কাজটি। বিদ্বেষের প্রতিস্পর্ধী সহিষ্ণুতার ভাষ্যকে জাতীয় পরিসরে জায়গা করিয়া দিতে হইবে। বিশ্ব উষ্ণায়নই হউক বা ‘অপর’-এর প্রতি বিদ্বেষ, এই অসুরগুলি প্রকৃত প্রস্তাবে অন্তরের। তাহাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কঠিন। কিন্তু, সেই যুদ্ধেও জয়লাভ সম্ভব, যদি অতীতের খাঁচা ভাঙিয়া নূতন ভবিষ্যৎকে সন্ধান করিবার স্পর্ধা থাকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy