সম্প্রতি পাভলভ মানসিক হাসপাতালে গলায় ডিম আটকাইয়া যুবকের মৃত্যু এক মর্মান্তিক চিত্র তুলিয়া ধরিল। মনোরোগীদের অসহায়তা এবং তাঁহাদের প্রতি নিদারুণ অবহেলার চিত্র। ক্ষুধার তাড়না এবং দ্রুত আহার শেষ করিবার জন্য হাসপাতালের কর্মীদের ধমক— যুগপৎ একটি তরতাজা প্রাণ শেষ করিয়া দিল। অভিযোগ, শ্বাসরুদ্ধ হইয়া যুবক যখন ছটফট করিতেছিলেন, কোনও নার্স সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। জায়গাটি সরকারি হাসপাতাল। মানসিক রোগীরা সেখানে চিকিৎসা করাইতে যান। তাঁহারা যাহাতে উপযুক্ত চিকিৎসা, যত্ন, আহার্য পান, তাহা নিশ্চিত করিবার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। ইহাই কি সেই দায়িত্ববোধের নমুনা?
বহু বারই এই হাসপাতালের রোগীদের শোচনীয় অবস্থার চিত্রটি উঠিয়া আসিয়াছে। কখনও জানা গিয়াছে, অযত্নে তাঁহাদের শরীরে উকুন ঘুরিয়া বেড়ায়, কখনও ওয়ার্ডের বাহিরে দীর্ঘ ক্ষণ মৃতদেহ পড়িয়া থাকে। হাসপাতালের অভ্যন্তরে এক রোগীর মারে অন্য রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটিয়াছে। এবং সেখানেও একই অভিযোগ শুনা গিয়াছিল যে, কোনও নার্স বা কর্মী গোলমাল থামাইতে অগ্রসর হন নাই। যেখানে মানসিক হাসপাতালে ‘ক্রনিক’ রোগী, ‘অ্যাকিউট’ রোগী এবং রোগমুক্তদের আলাদা রাখিবার প্রয়োজন, সেখানে এই হাসপাতালে সেই নিয়ম মানা হয় না। রোগীর আহারের সময় লইয়াও বিস্তর অভিযোগ। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার পর সকাল আটটায় তাঁহারা ফের খাইতে পান। মধ্যবর্তী সময়ে সামান্যতম খাবারের ব্যবস্থা নাই। শুনা যায়, আহার গ্রহণের সময় অনেক ক্ষেত্রেই প্রশিক্ষিত কর্মীরা উপস্থিত থাকেন না। থাকে না গলায় খাবার আটকাইয়া গেলে তাহা নিষ্কাশনের যন্ত্র। ফলে, ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় যাঁহাদের গলাধঃকরণে সমস্যা হয়, তাঁহাদের ক্ষেত্রে এই রূপ দুর্ঘটনা ঘটিবার সমূহ সম্ভাবনা। সর্বোপরি, অভাব সংবেদনশীলতার। প্রায়শই শুনা যায়, অতিরিক্ত রোগীর চাপে নজরদারিতে ত্রুটি থাকিয়া যাইতেছে। কিন্তু রোগীর চাপ সংবেদনশীলতার অভাবের কারণ হইতে পারে না। ইহার জন্য প্রশিক্ষণের পাশাপাশি মনোরোগীদের সেবার উপযুক্ত মানসিকতা প্রয়োজন। দুর্ভাগ্য, সরকারি হাসপাতালেও ইহার নিদারুণ অভাব।
সমাজের মনোভাবও অনুরূপ। বস্তুত, পাভলভের অবস্থা বৃহত্তর ক্ষেত্রে মনোরোগীদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির এক ক্ষুদ্র প্রতিফলনমাত্র। শারীরিক অসুস্থতার ন্যায় মনের অসুখও যে ‘অসুখ’, ঠিকমতো চিকিৎসা করাইলে যে তাহার নিরাময় সম্ভব, সেই কথা এখনও সমাজ স্বীকার করিতে চাহে না। ফলত, সুস্থ হইয়া গেলেও অনেক ক্ষেত্রেই রোগীদের বাড়িতে ফিরাইয়া লওয়া হয় না। ঔষধের সঙ্গে স্নেহ-মমতার স্পর্শও এই রোগীদের ক্ষেত্রে একান্ত প্রয়োজনীয়। অথচ, এই সত্যটি সমাজ ভুলিয়া থাকে। পরিবারের কেহ মনোরোগে আক্রান্ত হইলে চিকিৎসার বদলে তাহাকে কখনও শিকলে বাঁধিয়া রাখা হয়, কখনও ওঝা, জ্যোতিষীর শরণ লওয়া হয়, বঞ্চিত করা হয় সম্পত্তির উত্তরাধিকার হইতেও। অথচ, দুই বৎসর পূর্বে এই পাভলভেরই ৫০ জন রোগী ভোটাধিকার পাইয়াছিলেন। আশা জাগিয়াছিল, মনোরোগীও যে সমাজের মূলস্রোতেরই মানুষ, গণতান্ত্রিক অধিকার দানের ফলে সেই বোধ জাগিবে। তাহা হয় নাই। মনোরোগীদের আস্ত ‘মানুষ’ বলিয়া ভাবিতেও এই সমাজের ঢের বিলম্ব আছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy