নীরব রইলেন ইরানের জাতীয় দলের ফুটবলাররা। ছবি: সংগৃহীত।
মৌন যে স্রেফ সম্মতির লক্ষণ নয়, প্রতিবাদেরও অস্ত্র, বুঝিয়ে দিলেন ইরানের জাতীয় দলের ফুটবলাররা। কাতারে ফুটবল বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচ শুরুর আগে জাতীয় সঙ্গীত বেজে উঠলেও নীরব রইলেন প্রত্যেকে। হিজাব-বিরোধিতা নিয়ে ইরানে সাধারণ মানুষের উপর ধরপাকড় হেনস্থা অত্যাচার চলছে, নীতিপুলিশের নির্যাতনে মাহশা আমিনের মৃত্যুর পর থেকে এ পর্যন্ত মৌলবাদী শাসকের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত অন্তত ছ’জন, ফাঁসি হতে পারে আরও একুশ জনের, জনবিক্ষোভ থামাতে চলছে লাঠি গুলি গ্রেফতার। সাধারণ মানুষ, বিশেষত নারীদের সঙ্গে প্রতিবাদে সরব হয়েছেন ইরানের বহু লেখক অভিনেতা শিল্পী, শাসকের অতিনিয়ন্ত্রণে সব সময় তা প্রকাশ্যে আসতে পারেনি। সেই বাঁধই ভেঙে গেল ফুটবল মাঠে, টিভির পর্দায় সারা বিশ্বের মানুষ দেখলেন জাতীয় সঙ্গীত বেজে উঠলেও ইরানের খেলোয়াড়দের ঠোঁট নড়ছে না, এমন আবেগী মুহূর্তেও গলা কাঁপছে না কারও। এই নীরবতা তাঁদের প্রতিবাদ। ম্যাচ শেষে সাংবাদিক বৈঠকে ইরানি অধিনায়ক স্পষ্ট বলেছেন দেশের পরিস্থিতি মোটেই ভাল নয়, তাঁরা দেশের মানুষের সঙ্গে আছেন। বিশ্বকাপ শেষে ঘরে ফিরলে তাঁদের জন্য কোন শাস্তি অপেক্ষা করে আছে তা বলা যায় না; বিশ্বের প্রচারের আলো এসে পড়ায় হয়তো প্রাণ যাবে না, ধন মান ক্রীড়াজীবনের হয়তো এ-ই শেষ।
তবু প্রতিবাদের এই ধরন, এবং তার সততা— আশা জাগায়। ভরসা জোগায়, শাসকের জনবিরোধী, স্বৈরতান্ত্রিক অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে এ ভাবেও এত শক্তিশালী বার্তা দেওয়া যায় তা হলে! খেলোয়াড়দের কাজ খেলা, প্রতিবাদ করা নয়, ইরানের ফুটবলাররা ভাবতেই পারতেন। দেশে যা-ই হয়ে চলুক না কেন, বিশ্বকাপের মতো প্রতিযোগিতার আসরে খেলার উপরেই সবটুকু মনোযোগ দেওয়া সর্বার্থে বাঞ্ছিত, এ ভাবনা অসঙ্গত ছিল না। তা সত্ত্বেও তাঁরা অন্য রকম ভেবেছেন। প্রতিবাদ বলতেই সচরাচর প্রকাশ্য সংঘাত ও বিক্ষোভের রূপটি মাথায় আসে, যেমন চলছে ইরানের রাস্তায়। প্রতিবাদের এই চেহারাই বেশি দৃশ্যমান, হয়তো তাৎক্ষণিক ফল লাভে কার্যকরও। কিন্তু ইরানের খেলোয়াড়দের অন্য রকম প্রতিবাদে আজ যে বিশ্ব নড়েচড়ে বসেছে তার কারণ এই প্রতিবাদ অনায়াস অথচ প্রবল, নীরব অথচ বাঙ্ময়। এই প্রতিবাদ ক্ষুদ্রের ভাবমূর্তি বা লাভক্ষতির পরোয়া না করে বৃহতের কথা ভাবে, এমন মঞ্চ ও সময় বেছে নেয় যার গুরুত্ব অনস্বীকার্য, এবং সবচেয়ে বড় কথা, শাসকের অপশাসনকেও গা-সওয়া ভেবে প্রতিবাদের পথ থেকেই মুখ ফিরিয়ে নেওয়া এই সময়কে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, একটা বড় অন্যায়কে ছেড়ে দিলে তা কালে আরও বড় হয়ে ওঠে, সে জন্যই আশু প্রতিবাদ করা দরকার। দেশের কল্যাণে ‘স্বদেশ’-এরও ঊর্ধ্বে উঠতে বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, মানুষকে ছোট করে দেশকে তুলে ধরার বিপ্রতীপে ছিল তাঁর কবিতার বার্তা। বিশ্বক্রীড়ামঞ্চ আগেও এমন প্রতিবাদ দেখেছে— ১৯৩৬-এর বার্লিন অলিম্পিক্সে ধ্যানচাঁদ ও ভারতীয় দল হিটলারকে স্যালুট করেননি, সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এ প্রতিবাদ ছিল অভূতপূর্ব। বিশ্বকাপ ফুরোবে, ইরানও শান্ত হবে এক দিন, কিন্তু ইরানের এই খেলোয়াড়দের প্রতিবাদ ইতিহাস মনে রাখবে, দেশবাসীর প্রতি তাঁদের সৎ দায়বদ্ধতার জন্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy