২০০০ থেকে ২০১৯, এই দুই দশকে চরম আবহাওয়াজনিত বিপর্যয়ের সংখ্যা ছিল ৭,৩৪৮। প্রতীকী ছবি।
আরও একটি রিপোর্ট প্রকাশ করল রাষ্ট্রপুঞ্জের পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি)। আরও এক বার জানাল যে, এখনই যদি সর্বশক্তিতে চেষ্টা করা যায়, তা হলে হয়তো সুযোগ আছে এই বিশ্বের তাপমাত্রাকে প্রাক্-শিল্পায়ন যুগের তাপমাত্রার ১.৫ ডিগ্রির গণ্ডিতে বেঁধে রাখার। এখনই যদি শিল্পোন্নত দেশগুলি জীবাশ্ম-জ্বালানি ব্যবহারে কঠোর রাশ টানে, এখনই যদি সবুজ শক্তির ব্যবহারে অনেক বেশি জোর দেয়, হয়তো এখনও ত্রাণ আছে ভবিষ্যের। আশঙ্কা হয়, আইপিসিসি-র এই রিপোর্টটির ভাগ্যেও আগের যাবতীয় বিপদবার্তার মতো অপার উপেক্ষা রয়েছে। উষ্ণায়নের বিপদ অস্বীকার করার প্রবণতা গত কয়েক বছরে কমেছে, তা অনস্বীকার্য। সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে, রাষ্ট্রনায়করাও আগের চেয়ে সাবধানি— অন্তত মুখে; ডোনাল্ড ট্রাম্প যে ভঙ্গিতে উষ্ণায়নের বিপদের কথাকে উড়িয়ে দিতেন, এখন অধিকাংশ রাষ্ট্রনায়কই তার তুলনায় সুবিবেচক। কিন্তু, সেই সচেতনতা, বিবেচনা অবিলম্বে আর্থিক বা জ্বালানি নীতিতে রূপান্তরিত হবে, সে সম্ভাবনা ক্ষীণ, অতি ক্ষীণ। কেন, সেই কারণ বহুআলোচিত। সর্বজনের হিতের কথা ভেবে কোনও রাষ্ট্রই নিজের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সঙ্গে সমঝোতা করতে রাজি নয়। ফলে, প্রতি বছর রাষ্ট্রপুঞ্জের জলবায়ু সম্মেলনে স্থির হয়, সুদূর ভবিষ্যতের কোনও এক তারিখে সব রাষ্ট্র হাত থেকে মুছে ফেলবে জীবাশ্ম-জ্বালানির কালিমা, পৌঁছে যাবে ‘নেট জ়িরো’-য়। কিন্তু, এই মুহূর্তে পরিবেশের চেয়ে আর্থিক উন্নতি বেশি জরুরি।
কেন, আচরণবাদী অর্থশাস্ত্রের তত্ত্বে তার ব্যাখ্যা সম্ভব। ব্যক্তি-মানুষের মধ্যে প্রেজ়েন্ট বায়াস নামে একটি বায়াস বা চিন্তা-দোষ কাজ করে— আজকের, বা অদূর ভবিষ্যতের অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র লাভও সুদূর ভবিষ্যতের বিপুল লাভের তুলনায় অধিকতর আকর্ষক ঠেকে। আবার, ভিন্ন একটি তত্ত্ব বলে যে, ব্যক্তি-মানুষ তার ভবিষ্যৎ সত্তাকে দেখে অন্য কোনও ব্যক্তি হিসাবে— যার কাঁধে অপ্রিয় কাজের দায়িত্ব ঠেলে দিয়ে বর্তমান সত্তা দায় ঝেড়ে ফেলতে পারে। পরিবেশ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে যোগ হয় আরও একটি মাত্রা— এ ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎকে পৃথক সত্তা হিসাবে ‘বিবেচনা’ করার আর প্রয়োজন হয় না, তা পৃথক সত্তাই— অন্য কোনও নেতার নেতৃত্বে অন্য কোনও সরকার। ফলে, পরিবেশ রক্ষার জন্য অপ্রিয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়টি স্বচ্ছন্দে ঠেলে দেওয়া যায় সেই ভবিষ্যতের দিকে। ঘটনা হল, প্রবণতাটি আজকের নয়— ১৯৯০-এর দশকের গোড়ায়, যখন থেকে পরিবেশ বিষয়ক আলোচনায় গুরুত্ব দেওয়া শুরু হল, তখনও পরিবেশ রক্ষার্থে কাজ করার দায়টি ভবিষ্যতেরই ছিল। তখনকার সেই ভবিষ্যৎ আজ বর্তমান হয়েছে— আজকের রাষ্ট্রনায়করা আবার ভবিষ্যতের দিকে দায় ঠেলছেন। পরিবেশ অবশ্য এতশত বোঝে না, তা ক্রমেই আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে।
কতখানি ভয়ঙ্কর, সামান্য পরিসংখ্যান থেকেই তা স্পষ্ট হতে পারে। ২০০০ থেকে ২০১৯, এই দুই দশকে চরম আবহাওয়াজনিত বিপর্যয়ের সংখ্যা ছিল ৭,৩৪৮। সেই বিপর্যয়গুলিতে মোট মৃতের সংখ্যা বারো লক্ষেরও বেশি, আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় তিন লক্ষ কোটি ডলার। এর আগের দু’দশকে চরম আবহাওয়াজনিত বিপর্যয়ের সংখ্যা ছিল ৪,২১২। অর্থাৎ, দূর থেকে দেখলে বোঝা সম্ভব, বিপদ কী ভাবে বাড়ছে। সমস্যা হল দূর থেকে দেখাতেই। চল্লিশ বছর আগে পরিস্থিতি কেমন ছিল, মানুষ সচরাচর সেই তুলনা করে না— তুলনা হয় গত বছরের সঙ্গে, অথবা তার আগের বছরের সঙ্গে। এবং, সেই তুলনায় বিপদের মাপ সব সময়ই খানিক সহনীয় ঠেকে, মনে হয় যে, গত বছরের তুলনায় খুব খারাপ কিছু ঘটেনি। এই সয়ে যাওয়ার প্রবণতাই মানুষকে পরিবেশের বিপদের স্বরূপটি বুঝতে দেয় না। তাই, বিপদ ঠেকানোর উদ্যোগগুলিও আটকে যায় রাজনীতি আর অর্থনীতির জালে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy