Advertisement
E-Paper

ঐকান্তিক

কদা শান্তিনিকেতনে সাহিত্যসম্মেলনে তাঁহার ‘যমুনাবতী’ কবিতার প্রশংসা শুনিয়া কবি বুদ্ধদেব বসু বিরক্ত হইয়াছিলেন।

শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০২১ ০৫:১৭
Share
Save

কবির সামাজিকতা ও স্বাদেশিকতা কি থাকিতে নাই? কেহ কেহ বলিবেন থাকিতেই পারে, কিন্তু তাহা বাহ্য; কবির অন্তর ‘ক্ষীণ, অলক্ষ্য, দুর্গম আর পুলকে বধির।’ সেই অন্তরই তো কাব্য রচনায় মগ্ন। যথার্থ কবি তাই বলিবেন, ‘জগতেরে ছেড়ে দাও, যাক সে যেখানে যাবে;’ কবির এই আত্মগত উদাসীন শান্ত ছন্নছাড়া রূপের পূজারি ছিলেন বুদ্ধদেব বসু। ‘রাত তিনটের সনেট’ কবিতায় পবিত্র-ব্যক্তিগত মুহূর্তের পক্ষে যুক্তি বিন্যাস করিয়াছিলেন, কবির ন্যায় মরমিয়া সাধকদেরও তিনি ঐকান্তিক মানুষ হিসাবেই চিহ্নিত করিতে চাহিয়াছিলেন। এই অভিমত সত্য, কিন্তু পূর্ণ সত্য নহে। ব্যক্তিগত ও সামাজিক দুইয়ের মধ্যে কেহ-কেহ চলাচল করিতে পারেন। শ্রীচৈতন্যদেব কীর্তনপ্রচার কালে কেবল ভাব-সমাহিত চিত্তে রাধাভাবের আস্বাদনই করিতেন না, তাঁহার কীর্তন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের আয়ুধে পরিণত হইয়াছিল। আবার কাজির বাড়ির সম্মুখ দিয়া যে-ক্ষণে দলবদ্ধ ভাবে চৈতন্যদেব ও তাঁহার অনুগামীরা কীর্তন করিয়া যাইতেন, সে-ক্ষণে তাঁহাদের দলবদ্ধতা কাজিকে সচকিত করিত। প্রশাসক হিসাবে যাহা ইচ্ছা তাহা করিবার অন্তর্গত বাসনা কাজি সংযত করিতেন। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও অন্তর্জীবন আর বহির্জীবনের মধ্যে সহজ যাতায়াত স্পষ্ট। অন্তর্মুখী কবি যখনই প্রয়োজন হইয়াছে, সরব হইয়াছেন। ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে যে ভাবে গান গাহিয়া রবীন্দ্রনাথ পথে নামিয়াছিলেন, পরে সেই ভাবে পথে না নামিলেও সামাজিক ও রাজনৈতিক সঙ্কটের সময় বারংবার তিনি মত প্রকাশ করিয়াছেন। জালিয়ানওয়ালা বাগের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে, সুভাষচন্দ্র-ওটেন বিতর্কের সময় সুভাষের পক্ষে, গাঁধীর অনশনব্রত ভঙ্গ করিবার আহ্বানে তিনি উচ্চকণ্ঠ। আন্তর্জাতিক সঙ্কটেও রবীন্দ্রনাথের মতামত গুরুত্ব পাইয়াছে। বিশেষ করিয়া আন্তর্জাতিক স্তরে ফ্যাসিবাদের মোকাবিলায় তাঁহার সরবতার অবধি নাই।

সদ্য-প্রয়াত কবি শঙ্খ ঘোষের ‘স্বদেশ’ কবিতার দু’টি পঙ্‌ক্তি এই সূত্রে উদ্ধৃতি যোগ্য। ‘সঙ্গদানে শক্তি দেয় কবি শিল্পী বিজ্ঞানী সন্ন্যাসী— / দীক্ষা দেয় তারা, আর দীক্ষা নিতে চায় সকলেরই।’ কবি, শিল্পী, বিজ্ঞানী, সন্ন্যাসী সকলেরই সমাজকে সঙ্গদানের দায়িত্ব রহিয়াছে। তাঁহারা অপরাপর সামাজিক মানুষকে নিজ ভাবনায় দীক্ষা প্রদান করিবেন, আবার সাধারণ সামাজিকের নিকট দীক্ষিতও হইবেন। অর্থাৎ, নিজেদের সমাজ ও স্বদেশ হইতে তাঁহারা দূরে রাখিবেন না। শঙ্খ ঘোষ কবির যে আদর্শ নির্দেশ করিয়াছিলেন, তাহা স্বয়ং পালনও করিয়াছিলেন। একদা শান্তিনিকেতনে সাহিত্যসম্মেলনে তাঁহার ‘যমুনাবতী’ কবিতার প্রশংসা শুনিয়া কবি বুদ্ধদেব বসু বিরক্ত হইয়াছিলেন। বলিয়াছিলেন, কেবল বাস্তব ক্ষুধার কথা লিখিলেই কবিতা হয় না। বুদ্ধদেব বসুর কাব্যভাবনা সেই দিনের শঙ্খকে প্রভাবিত করিতে পারে নাই। তরুণ শঙ্খ অগ্রজ কবির তিরস্কারে আপনার মত পরিবর্তন করিয়াছিলেন বলিয়া মনে হয় না— গাঢ় প্রণয়ের ঐকান্তিক কবিতা রচনার পাশাপাশি পদ্যে ও গদ্যে দেশ-কাল-সমাজের কথা প্রকাশ করিয়াছেন। এই দুই পক্ষের মধ্যে তিনি কোনও বিরোধ দেখেন নাই। বাঁশ দিয়া বাঁশিও হয়, লাঠিও গড়া চলে। যখন যেটির প্রয়োজন সেটির নির্মাণ বিধেয়। বিশেষ করিয়া বিগত দুই দশকে পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মূল্যবোধের অবক্ষয় যখন মাত্রাছাড়া, তখন তাঁহার কণ্ঠ জাগ্রত বিবেকের ন্যায় জনগণকে ভরসা দিয়াছে, পথ দেখাইয়াছে। কোনও রাজনৈতিক দলের অনাচারকেই তিনি প্রশ্ন করিতে দ্বিধা করেন নাই। পশ্চিমবঙ্গের বাম শাসনের অন্তিমপর্বে উদ্ধত শাসকের বিরুদ্ধে তিনি সাধারণ মানুষের পক্ষ গ্রহণ করিয়াছিলেন। পরিবর্তনের পর যে সরকার আসিল, সেই সরকারের দুর্নীতি ও দুরাচারও তাঁহার কবিতায় ছায়া ফেলিয়াছে। হিন্দুত্ববাদী স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে তাঁহার কলম বিদ্যুৎবাহী— তিনি নাৎসি জার্মানির ইতিহাস স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন।

যিনি বিবেকপ্রতিম, তিনি রাজনৈতিক দলবিশেষের হইয়া কথা বলিবেন না; সামাজিক মানুষের পক্ষ লইয়া ন্যায়-অন্যায়ের ভেদ নির্দেশ করিবেন। প্রবীণ শঙ্খ ঘোষ তাহা করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। তাঁহার এই বিবেকপ্রতিম ভূমিকা মেকি ছিল না। বঙ্গদেশের কবি-শিল্পীকুলে এমন মানুষ বিরল, যিনি অত্যন্ত সততার সহিত এই দায়িত্ব গ্রহণ করিতে পারেন। কবি শঙ্খ ঘোষের প্রয়াণ আমাদের রিক্ত করিয়াছে। তাঁহার জাগ্রত বিবেকের প্রস্থান আমাদের শূন্য করিয়াছে।

Sankha Ghosh Bengali Poet

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।