প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কোনও খাদ্যই পায়নি, এমন শিশুর সংখ্যা ভারতে সাতষট্টি লক্ষ। পঞ্চম জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা (২০১৯-২০) থেকে আন্তর্জাতিক গবেষক দল নিষ্কাশিত এই তথ্য ভারতের স্থান নির্ধারণ করেছে দক্ষিণ এশিয়ার সব ক’টি পড়শি দেশের পিছনে। ১৯.৩ শতাংশ খাদ্যহীন শিশু (জ়িরো ফুড চিলড্রেন) নিয়ে ভারত স্থান পেয়েছে কেবল আফ্রিকার দু’টি দরিদ্রতম দেশের আগে— গিনি ও মালি। অর্থনীতির মাপের নিরিখে ভারতের সঙ্গে যাদের তুলনাই চলে না। কী করে ভারতের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে দু’বছরের কম বয়সি শিশুদের মধ্যে ক্ষুধা ও অপুষ্টির এই তীব্রতা দেখা গেল, তা বিশেষজ্ঞদেরও ভাবিয়েছে। অনেকগুলি প্রশ্ন তোলে এই ছবিটি। প্রথম প্রশ্ন অবশ্যই ভারতের খাদ্য সহায়তা প্রকল্পগুলির সার্থকতা নিয়ে। রেশনে সুলভে চাল-গম, অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্প প্রভৃতি বহু দিন চালু ছিল, অতঃপর জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা আইন (২০১৩) পাশ হয়েছে। কেন্দ্রের দাবি, ভারতে দারিদ্র কমেছে, মেয়েদের কর্মনিযুক্তি বেড়েছে। অথচ, শিশু-অপুষ্টির ছবিতে লক্ষণীয় উন্নতি দেখা যাচ্ছে না। বরং পঞ্চম জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা দেখিয়েছে, পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের মধ্যে পঁয়ত্রিশ শতাংশেরই অপুষ্টির কারণে উচ্চতায় ঘাটতি রয়েছে (স্টান্টেড)। খাদ্যশূন্য শিশু এই সামগ্রিক অপুষ্টি-চিত্রের আর একটি মাত্রা। কেন শিশু-অপুষ্টি কমছে না, তার উত্তরও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
ভারতের পুষ্টিচিত্রের সঙ্গে পরিচিত বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, কেবল খাদ্যের অভাব দিয়ে শিশু-অপুষ্টির ব্যাখ্যা করা চলে না। দেখতে হবে শিশুকে খাওয়ানোর রীতি-অভ্যাস দিয়ে। শিশুকে দিনের মধ্যে তিন-চার বার যথেষ্ট খাবার খাওয়ানোর জন্য পরিবারের যে পরিস্থিতি দরকার, তা বাস্তবিক রয়েছে কি না। আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে নিহিত কারণগুলি শিশু-অপুষ্টি তৈরি করতে পারে, সতর্ক করেছেন তাঁরা। তাঁদের এই বক্তব্যকে নীতি ও প্রকল্পের পরিকল্পনায় যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া দরকার। একটি দু’বছরের শিশুর উপযুক্ত খাদ্যের খরচ দরিদ্র পরিবারের সাধ্যের বাইরে, এমন নয়। কিন্তু শিশুকে খাওয়ানো বস্তুত শিশুর সার্বিক পরিচর্যার একটি অঙ্গ। সে ব্যবস্থা না থাকলে পুষ্টিবিধানও সম্ভব নয়। রাষ্ট্র থেকে পরিবার, সব ব্যবস্থাই এই দায় চাপিয়ে এসেছে পরিবারের মেয়েদের উপরে। অথচ, যৌথ পরিবারে ভাঙন, গ্রাম থেকে শহরমুখী পরিযাণ, দরিদ্রতর রাজ্যগুলি থেকে পুরুষদের সমৃদ্ধতর রাজ্যগুলিতে পরিযাণ, এগুলি মেয়েদের দায়িত্বের চাপ বাড়িয়েছে। রোজগার করতে গিয়ে বহু দরিদ্র মেয়ে শিশুর পরিচর্যায় যথেষ্ট সময় দিতে পারে না। বহু মা নিজেরাও অপুষ্ট।
এই পরিস্থিতির মোকাবিলাতেই কেন্দ্র ১৯৭৫ সাল থেকে অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্প চালিয়ে আসছে। আক্ষেপ, প্রতি বছর নতুন নতুন শিরোনামে সেই পুরনো প্রকল্পের প্রচার হচ্ছে, কিন্তু বরাদ্দ যথেষ্ট বাড়ছে না। ছয় মাস থেকে তিন-চার বছরের শিশুর পুষ্টি ও প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার যা হাল ভারতে, তা লজ্জাজনক। ঘণ্টাদুয়েক খিচুড়ি বিতরণ করেই সেগুলি দায় সারে। পাশাপাশি, কর্মরত মায়েদের জন্য কর্মস্থলে ক্রেশ তৈরির জন্য বরাদ্দ টাকা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে থাকলেও, রাজ্যগুলি তা দাবি করে না। এর কারণ, সরকারি প্রকল্পগুলির প্রধান উপযোগিতা হয়ে উঠেছে দলীয় প্রচার আর আইনরক্ষা। নাগরিকের চাহিদা মেটানোর লক্ষ্য এখন গৌণ। এই কারণেই সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি রাজ্যগুলিকে বলেছে, ‘কমিউনিটি কিচেন’ বা সামূহিক রসুই তৈরি করা অপুষ্টি নিবারণের উপায় হতে পারে কি না, তা ভেবে দেখতে। আদালত সরাসরি রসুই নির্মাণের নির্দেশ দেয়নি। কিন্তু আদালতের বক্তব্য এ দিকেই নির্দেশ করে যে, দরিদ্র কিংবা নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশুর কী ধরনের সহায়তা প্রয়োজন, তা পর্যবেক্ষণ করে, সেই মতো তৈরি করতে হবে পুষ্টিবিধান ও পরিচর্যার প্রকল্পকে। শিশু-সুরক্ষার এই গুরুতর দাবিটি নারী দিবসে তোলাই হয়তো উপযুক্ত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy