কেন্দ্রীয় দূষণ পর্ষদের পরিমাপে কলকাতার সাতটি এলাকার পাঁচটিতেই বাতাসের মানের সূচকে ‘অত্যন্ত খারাপ’ পর্যায় মিলেছে। প্রতীকী ছবি।
কলকাতার এক ভয়ঙ্কর সঙ্কট হয়ে দেখা দিচ্ছে বায়ুদূষণ। বাতাসের মানের মূল্যায়ন ফল ভীতিপ্রদ— কেন্দ্রীয় দূষণ পর্ষদের পরিমাপে কলকাতার সাতটি এলাকার পাঁচটিতেই বাতাসের মানের সূচকে ‘অত্যন্ত খারাপ’ পর্যায় মিলেছে, বাকি দু’টিতে মিলেছে ‘তীব্র’ পর্যায়, যা সূচকের নিম্নতম মান। যার অর্থ, মানবদেহের পক্ষে বিপজ্জনক কলকাতা শহরের অধিকাংশ অঞ্চলের বাতাস। বিশেষত বাতাসে ভাসমান ক্ষতিকারক কণা পিএম ২.৫ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত মাত্রার থেকে কলকাতায় অনেক বেশি— ২০১৯ সালের একটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষা অনুসারে অন্তত আট গুণ বেশি। এর ফলে সুস্থ শরীরেও শ্বাসকষ্ট-সহ নানা অসুখের সূত্রপাত হতে বাধ্য, অসুস্থদের সমস্যা আরও তীব্র হবে। অথচ, বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসনের তৎপরতা আশা জাগায় না। দীপাবলিতে দূষণকারী বাজির প্রকোপ কমেনি, দেখা যায়নি দূষণকারী যান, জ্বালানি প্রতিরোধের চেষ্টা। এই অনিয়ন্ত্রণের ফল চোখের সামনেই রয়েছে— দিল্লি। ভারতের রাজধানীতে প্রতি শীত কালে জনজীবন, জনস্বাস্থ্য কতখানি বিপর্যস্ত হয়, তার প্রমাণ প্রতি বছরই মিলছে। ভারতে সর্বাধিক দূষিত শহরের সূচকে এখনও দিল্লি শীর্ষে, কিন্তু দূষণ বৃদ্ধির হারের নিরিখে কলকাতা ভারতের অন্য শহরগুলিকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। অতিক্রম করেছে গত বছরের দূষণের মাত্রাকেও, বলছে কেন্দ্রের তথ্য। এর পরিবেশগত কারণও রয়েছে— ২০২১-২২ সালের শীতকালে লকডাউনের প্রভাবে কলকাতায় দূষণ কিছু কম ছিল। ২০২২-২৩ সালের শীতে বাতাসে আর্দ্রতাও তার আগের শীতের মরসুমের তুলনায় বেশি হওয়ায়, দূষণকারী ভাসমান কণা বাতাসে এ বছর বেড়েছে। কিন্তু এই সব সমস্যাকে ছাপিয়ে উঠছে যে প্রধান সঙ্কট, তা হল নীতির অভাব। কলকাতার বায়ুদূষণ কমানোর কোনও নিবিড় পরিকল্পনা এখনও অবধি চোখে পড়ছে না।
কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারের তরফে কলকাতায় বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে যে প্রধান ব্যবস্থার কথা ঘোষণা করা হয়েছে, তা হল বিদ্যুৎচালিত বাস রাস্তায় নামানো। সারা দেশে দূষণ কমাতে ৫০ হাজার বিদ্যুৎচালিত বাস কেনার পরিকল্পনা করেছে কেন্দ্র, এর জন্য ১ হাজার কোটি টাকা ধার্য করেছে। পশ্চিমবঙ্গে ২০২৩ সালের মধ্যে এগারোশো বাস চালু হবে, ঘোষণা করেছে রাজ্য। প্রশ্ন হল, যদি বা এ কাজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হয়, তাতে লাভ হবে কতটুকু? সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে অন্তত দশ হাজার বাস নথিভুক্ত কলকাতায়। চলে বিপুল সংখ্যক বাণিজ্যিক ও ব্যক্তিগত গাড়ি। ২০০৮ সালে কলকাতা হাই কোর্ট পনেরো বছরের পুরনো গাড়ি বাতিল করতে বলেছিল, ২০২২ সালে জাতীয় পরিবেশ আদালত ফের সেই নির্দেশ দিয়েছে। বাতিলযোগ্য লক্ষাধিক গাড়ি নির্দিষ্টও করেছে পরিবহণ দফতর। কিন্তু কলকাতার যাত্রিবাহী ট্যাক্সি, মালবাহী যানগুলিকে দেখলে সংশয় জাগে, সরকার এই লক্ষ্যে কতটা উদ্যোগী?
তবে কিনা, পরিবহণ নগর-দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ হলেও, একমাত্র কারণ নয়। কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলিতে দূষণকারী শিল্প প্রচুর। এলপিজি গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাণিজ্যিক ও গার্হস্থ প্রয়োজনে দূষণকারী জ্বালানির ব্যবহার বাড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সেই সঙ্গে, কলকাতায় বড় গাছের সংখ্যা দ্রুত কমছে। কেন্দ্রের একটি রিপোর্ট অনুসারে, ২০১১-২১ সালের মধ্যে কলকাতা তার বনভূমির ৩০ শতাংশ হারিয়েছে। দিল্লির সঙ্গে অনেক সময়ই কলকাতার দূষণের তুলনা চলে, কিন্তু দিল্লির সবুজায়নের সঙ্গে কলকাতা কখনও নিজের তুলনা করে কি? সদিচ্ছা থাকলে রাজ্য অনেক সুসংহত উদ্যোগ করতে পারত। কিন্তু না, স্বল্পমেয়াদি লাভ, ক্ষুদ্র স্বার্থই এখানে গুরুত্ব পায়। মূল্য দেন অগণিত নাগরিক— বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy