সুপ্রিম কোর্ট। ফাইল চিত্র।
সমালোচনা এড়াতে বাক্স্বাধীনতা, বা সংবাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না সরকার, ফের মনে করাতে হল সুপ্রিম কোর্টকে। মালয়ালম সংবাদ চ্যানেল ‘মিডিয়া ওয়ান’-এর সম্প্রসারণ বন্ধ করেছিল কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক। অভিযোগ ছিল, দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছে ওই চ্যানেলটি। সেই দাবি খারিজ করে চ্যানেলকে লাইসেন্স ফেরাতে নির্দেশ দিল সুপ্রিম কোর্ট। সংবাদমাধ্যমের সপক্ষে সুপ্রিম কোর্টের এমন সওয়াল নতুন নয়। তবু এই রায়টি কয়েকটি কারণে বিশেষ ভাবে প্রণিধানযোগ্য। প্রথমত, সরকারের সমালোচনাই যে সংবাদমাধ্যমের স্বাভাবিক কাজ, তা ফের মনে করাল শীর্ষ আদালত। চ্যানেলটিতে প্রচারিত সরকারি নীতির সমালোচনা ‘প্রতিষ্ঠান-বিরোধী’ বলে কেন্দ্র অভিযোগ করেছিল। প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় এবং বিচারপতি হিমা কোহলি সে অভিযোগ নাকচ করেছেন। সেই সঙ্গে বলেছেন যে, এমন দাবির মধ্যেই নিহিত রয়েছে সরকারের এই প্রত্যাশা যে, সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠানকে সমর্থন করবে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, এবং রাজনৈতিক আদর্শের প্রশ্নে সমাজে দ্বিমত না থাকাটাই গণতন্ত্রের পক্ষে আশঙ্কাজনক, বলেছেন বিচারপতিরা। সংবিধানের ১৯(২) ধারায় সংবাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের যে কারণগুলি বলা রয়েছে (দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়া, কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষতি, অশান্তি তৈরির চেষ্টা, ব্যক্তির অবমাননা, প্রভৃতি) তার মধ্যে কখনওই স্থান দেওয়া যায় না সরকারি নীতির সমালোচনাকে, মনে করিয়েছে শীর্ষ আদালত।
গণতন্ত্রের একেবারে গোড়ার এই কথাটি একটা নির্বাচিত সরকারকে বোঝাতে হল সুপ্রিম কোর্টকে, কারণ এই অযৌক্তিক প্রত্যাশাকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। কিছু দিন আগেই কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী কিরেন রিজিজু সরকারের বিরোধিতাকে ‘দেশবিরোধিতা’ বলে দাবি করেছিলেন। কোনও সরকারই কখনও সংবাদমাধ্যমের কাছে আনুগত্য দাবি করতে পারে না, দেশবাসীর কাছে শীর্ষ আদালতের এই বার্তা মূল্যবান। দ্বিতীয়ত, নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার জুজু দেখিয়ে সংবাদের স্বাধীনতা নস্যাৎ করার যে কৌশল বার বার নিচ্ছে মোদী সরকার, তাকে বিদ্ধ করল এই রায়টি। জামাত-ই-ইসলামি নামে যে সংগঠনটির সঙ্গে ‘মিডিয়া ওয়ান’-এর সম্পর্ক রয়েছে বলে অভিযোগ করেছিল কেন্দ্র, সেই সংগঠনটি নিষিদ্ধ নয়, এবং এই যোগাযোগ দেশের নিরাপত্তা জন্য হানিকারক, এমন দাবিও আদালতের ধোপে টেকেনি। নিরাপত্তাহানির অভিযোগ সরকার যথেষ্ট বিবেচনা না করেই তুলেছে, বিচারপতিদের এই মন্তব্য বস্তুত তিরস্কার। রায়ের এই অংশটি দৃষ্টান্ত হিসাবে মূল্যবান, কারণ সাংবাদিক ও সমাজকর্মীদের ভীতিপ্রদর্শনের একটি অস্ত্র হয়ে উঠেছে নিরাপত্তাহানির অভিযোগ।
সাংবাদিকের সঙ্গে বহু ব্যক্তি ও সংগঠনের যোগাযোগ থাকাই স্বাভাবিক। কেবল সেই কারণে সাংবাদিক নিজেই সন্দেহভাজন, এবং তাঁর কার্যকলাপ দেশের পক্ষে বিপজ্জনক, এমন দাবি অর্থহীন। অথচ, কাশ্মীর-সহ দেশের সর্বত্র সাংবাদিক ও চিত্রসাংবাদিকদের গ্রেফতার, আইনি হয়রানি এবং ভীতিপ্রদর্শন করা হচ্ছে সেই অজুহাতে। এর বিরূপ প্রভাব পড়ে বাক্স্বাধীনতায়, মনে করাল শীর্ষ আদালত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, শীর্ষ আদালত ফের স্বচ্ছতার মূল্য মনে করিয়ে দিল। ‘মিডিয়া ওয়ান’-এর কার্যকলাপ যে নিরাপত্তা লঙ্ঘন করেছে, তার প্রমাণ কেরল হাই কোর্টকে বন্ধ খামে জমা দিয়েছিল কেন্দ্র। অভিযোগগুলি কী, তা জানতে পারেননি চ্যানেল-এর কর্তাব্যক্তিরাও। এই গোপনীয়তা ন্যায় এবং স্বচ্ছতার নীতিকে আঘাত করে, মনে করাল সুপ্রিম কোর্ট। আক্ষেপ, রাজনীতি যদি নাগরিকের স্বাধিকারকে সম্মান করত, তা হলে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা অপ্রতিহত রাখতে বার বার সরব হতে হত না আদালতকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy