Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Gujarat University

(অ)বিদ্যাতীর্থপ্রাঙ্গণ

স্বার্থটি যে রাজনৈতিক, মতলবটি যে দুরভিসন্ধি, তা পরিষ্কার। নইলে হামলাকারীরা এই ‘যুক্তি’তে চড়াও হত না: নমাজ পড়তে চাইলে মসজিদে যাও, এখানে কেন?

Gujarat University

— ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ২৭ মার্চ ২০২৪ ০৭:৫৬
Share: Save:

যোগঃ কর্মসু কৌশলম্‌। গুজরাত ইউনিভার্সিটির প্রতীকচিহ্নে শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতার এই উদ্ধৃতি অনেকের নজরে পড়তে পারে, যা বলে— কর্মে দক্ষতাই যোগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবাদর্শ হিসাবে চমৎকার, সন্দেহ নেই। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে? গত সপ্তাহে এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক হস্টেল প্রাঙ্গণে ঢুকে তাণ্ডব করে গেল বহিরাগত দুষ্কৃতীর দল। শ্রীলঙ্কা আফগানিস্তান তাজিকিস্তান ও আফ্রিকার নানা দেশ থেকে পড়তে আসা কিছু ছাত্র ছাত্রাবাসের মধ্যেই একটি চাতালে নমাজ পড়ছিলেন— তাই। ছাত্ররা মার খেয়েছেন, কয়েকজন গুরুতর আহত ও হাসপাতালে ভর্তি, ঘরে ঢুকে নষ্ট করা হয়েছে তাঁদের ল্যাপটপ, তছনছ হয়েছে জিনিসপত্র। তাণ্ডবকারীদের মুখে ছিল রাজনৈতিক স্লোগান, এবং সর্বাঙ্গে পরধর্মবিদ্বেষ— নইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসের চার দেওয়ালের মধ্যে কোথায় কোন ছাত্র ঘুমোচ্ছে না নমাজ পড়ছে, নিরামিষ খাবার খাচ্ছে না আমিষ, এ সবে কারও ভ্রুক্ষেপ করারও কথা নয়— যদি না ক্ষুদ্র স্বার্থ বা মতলব জড়িয়ে থাকে।

স্বার্থটি যে রাজনৈতিক, মতলবটি যে দুরভিসন্ধি, তা পরিষ্কার। নইলে হামলাকারীরা এই ‘যুক্তি’তে চড়াও হত না: নমাজ পড়তে চাইলে মসজিদে যাও, এখানে কেন? বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবাসে কোন ছাত্র কী ভাবে নিজ ধর্মাচরণ করবেন তা বেঁধে দেওয়ার এরা কে, এ প্রশ্নের উত্তর অবশ্য জানা: এরা শাসকের পেশিশক্তি, তাই বিনা বাধায় বিশ্ববিদ্যালয় বা ছাত্রাবাসে ঢুকে যথেচ্ছাচার করতে পারে। গুজরাতের ঘটনায় রাজ্য থেকে দিল্লি সর্বত্র শোরগোল পড়েছে, দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে এফআইআর হয়েছে, আমদাবাদ পুলিশ ক’জনকে আটকও করেছে— আক্রান্তেরা ‘বিদেশি’ ছাত্র বলেই, এর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ভাবমূর্তিই শুধু নয়, সংশ্লিষ্ট দেশগুলির দূতাবাস ও ভারতের কূটনীতি জড়িয়ে গিয়েছে বলেই। এখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিদেশি ছাত্রদের আলাদা ছাত্রাবাসে নিরাপদতর জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার, বিদেশ মন্ত্রকের বিবৃতির পর পুলিশ-প্রশাসন তৎপর হয়ে উঠেছে। সবই ‘চোর পালানো’র পরে।

এহ বাহ্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন আতঙ্কের ঘটনাটির পর উপাচার্যের মন্তব্যটি অবিশ্বাস্য; তিনি বলেছেন, শুধু নমাজ বিদেশি ছাত্রদের উপর হামলার কারণ হতে পারে না; স্থানীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে ছাত্রদের অজ্ঞানতা, ছাত্রদের আমিষ খাওয়া ও উচ্ছিষ্ট ফেলে রাখা, এই সবই হামলাকারীদের উস্কে থাকবে, বিদেশি ছাত্রদের স্থানীয় সংস্কৃতির স্পর্শকাতরতা সম্পর্কে শেখানোর প্রয়োজন আছে। অর্থাৎ দোষ আক্রমণকারীর নয়, আক্রান্তের, তাঁরাই নিজেদের ‘বিপদ’ ডেকে এনেছেন। তাঁর মন্তব্যটি অতীব আপত্তিকর: নমাজ পড়া ‘একমাত্র’ কারণ হতে পারে না, এ কথার অর্থ কি তা হলে নমাজ পড়া ‘একটি কারণ’ তো বটেই? দোষ পরধর্ম অসহিষ্ণুতার নয়, দোষ কারও বিন্দুমাত্র শান্তিভঙ্গ না করে ছাত্রাবাসের ঘেরাটোপে একান্ত নিজস্ব ধর্মাচরণের? এই অসংবেদনশীলতা অতি দুর্ভাগ্যের। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য— সর্বাবস্থায় যাঁর ছাত্রদের অভিভাবক হয়ে রক্ষা করার কথা, বিশেষত বহিরাগত দুষ্কৃতীর আক্রমণ থেকে— তিনি যখন এ কথা বলেন তখন প্রমাণ হয়, নীতিহীনতা, অসহিষ্ণুতা বহু সংস্কৃতির বিষয়ে অজ্ঞানতা কী ভাবে অশিক্ষার রূপ নিয়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে গিলে ফেলেছে। ক্ষমতার পচন কত দূর ছড়িয়েছে যে, এমন ব্যক্তিকে কেবল দলমততোষণের গুণে বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শীর্ষে স্থাপিত করা হচ্ছে। ভিন দেশ থেকে আসা ছাত্ররা বুঝলেন, এ দেশ তাঁদের জন্য নিরাপদ নয়। আসন্ন নির্বাচনে যুবসমাজের প্রতি প্রধানমন্ত্রী মোদীর সবচেয়ে বড় তাস নাকি তাঁর ‘বিশ্বগুরু’ ভাবনা। এই যদি বিশ্বগুরুর দেশের বিশ্ববীক্ষা হয়, এই যদি দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ হয়, তবে বলতে হয়, গোটা পৃথিবীর কাছে ঘৃণা ও অসংবেদনশীলতার অশিক্ষা, অবিদ্যার তীর্থ হয়ে উঠছে এই ভারত।

অন্য বিষয়গুলি:

Gujarat attack
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy