প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উদ্দেশে চার জন মুখ্যমন্ত্রী-সহ ন’টি রাজ্যের আটটি বিরোধী দলের ন’জন নেতানেত্রী সম্প্রতি যে চিঠিটি লিখেছেন। ফাইল ছবি।
গণতন্ত্র থেকে স্বৈরতন্ত্রের দিকে যাওয়ার রকমারি রাস্তা আছে। দুনিয়া জুড়ে এ বিষয়ে বিস্তর প্রবন্ধ এবং বইপত্র লেখা হয়েছে। স্বাভাবিক, কারণ বিপদটা ঘনিয়েছে দুনিয়া জুড়েই, অনেক দেশ ইতিমধ্যেই সম্পূর্ণ বিপদগ্রস্ত। বিপন্নের তালিকায় ভারত প্রথম সারিতে। মানবাধিকার লঙ্ঘন থেকে শুরু করে মত প্রকাশের স্বাধীনতা দমন অবধি গণতন্ত্রের প্রতিকূল আচরণে এ দেশের শাসকরা অতিমাত্রায় তৎপর। উদার গণতন্ত্রের বিভিন্ন সূচকের ভিত্তিতে সম্পন্ন আন্তর্জাতিক সমীক্ষাগুলিতেও তার প্রতিফলন সুস্পষ্ট, স্বাধীনতার ক্রমাঙ্কনে ভারত ক্রমশই পিছিয়ে পড়ছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উদ্দেশে চার জন মুখ্যমন্ত্রী-সহ ন’টি রাজ্যের আটটি বিরোধী দলের ন’জন নেতানেত্রী সম্প্রতি যে চিঠিটি লিখেছেন, সেটি এই পরিপ্রেক্ষিতেই বিশেষ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের অভিযোগ, বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ইত্যাদির তদন্তের নামে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাগুলিকে যথেচ্ছ ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, আবার বিরোধী শিবির থেকে কেউ শাসকদের সঙ্গে যোগ দিলেই তাঁর সম্পর্কে তদন্ত থেমে যাচ্ছে। বিরোধীদের বক্তব্য, এ ভাবেই— ভয় দেখিয়ে প্রতিপক্ষকে দমনের কাজে কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলিকে ব্যবহার করে— ভারত গণতন্ত্র থেকে স্বৈরতন্ত্রের পথে চলেছে। বলা বাহুল্য, এটি অন্যতম পথ, একমাত্র নয়।
সরকারের বিরোধিতা করলে সিবিআই, ইডি ইত্যাদির সুনজরে পড়তে হয়, আর দল বদলে শাসক শিবিরে নাম লেখালে তারা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে— এই পরম্পরা পশ্চিমবঙ্গ-সহ নানা রাজ্যে এতটাই পরিচিত যে, প্রায়শই আগে থেকে বলে দেওয়া যায় কার ব্যাপারে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা কখন সক্রিয় হয়ে উঠবেন, কার ক্ষেত্রে কখন নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বেন। বিরোধী স্বর স্তব্ধ করাই এই আচরণের লক্ষ্য, এমন অভিযোগ শাসকরা অবশ্যই মানবেন না। তাঁরা যথারীতি পাল্টা অভিযোগ করে চলেছেন যে, তদন্তকারীরা তাঁদের কাজ করছেন, বিরোধী নেতারা সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। এহ বাহ্য। যে সব রাজ্যের নেতারা এই চিঠি লিখেছেন, সেখানে বিজেপির প্রতিনিধিরা সাংবাদিক সম্মেলন করে তাঁদের পাল্টা বক্তব্য জানাবার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন। কেন্দ্রীয় শাসকের ঘরে বসতি করলে কোন মন্ত্রবলে সব দুর্নীতির অভিযোগ এক বিশাল কেন্দ্রীয় ধামার নীচে চাপা পড়ে যায়, সেই প্রশ্নের সদুত্তর অবশ্যই তাঁদের কাছে মিলবে না, কারণ এ প্রশ্নের কোনও সদুত্তর নেই।
স্পষ্টতই, বিরোধী দলনেতারা নিজের নিজের বাস্তব সমস্যার তাড়নাতেই প্রতিবাদে সমবেত হয়েছেন। শুল্ক সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগে আপ নেতা ও দিল্লি সরকারের উপ-মুখ্যমন্ত্রী মণীশ সিসৌদিয়ার গ্রেফতারের ঘটনাই প্রতিবাদপত্রের প্রত্যক্ষ উপলক্ষ। দলীয় স্বার্থের এই ভূমিকাটি বাস্তব রাজনীতিরই অঙ্গ। প্রশ্ন হল, এই বিরোধিতার যৌথতা কতখানি প্রবল হতে পারে এবং তার মেয়াদই বা কত দূর। লক্ষণীয়, কংগ্রেস, ডিএমকে এবং বামপন্থী দলগুলি এই চিঠির শরিক হয়নি। অভিযোগের সঙ্গে তারাও একমত, স্বৈরতন্ত্রের বিপদ সম্পর্কেও তাদের সংশয় নেই, বরং পত্রলেখক নেতানেত্রীদের কারও কারও তুলনায় রাহুল গান্ধী বা এম কে স্ট্যালিন সেই বিপদের প্রশ্নে সচরাচর অনেক বেশি বাঙ্ময়। কিন্তু এই দলগুলি নিজের নিজের হিসাব মেনেই এই চিঠির শরিক হয়নি। আবার, যে দলগুলি এ ক্ষেত্রে সমবেত হয়েছে তারা অন্য সমস্ত প্রশ্নে, এমনকি গণতন্ত্রকে রক্ষা করার প্রয়োজনেও, শাসকের বিরুদ্ধে সর্বদা সমবেত হবে কি না, সে-কথা একেবারেই নিশ্চিত করে বলা যায় না— অভিজ্ঞতা তেমন কোনও ভরসা দেয় না। শাসকরা তা জানেন বলেই এমন দাপটের সঙ্গে গণতন্ত্রের স্বাস্থ্যহানি ঘটিয়ে চলতে পারেন। গণতন্ত্র যে পথেই স্বৈরতন্ত্রের অভিমুখে অগ্রসর হোক না কেন, তাকে রক্ষা করার পথ কিন্তু একটিই। তার নাম: যথার্থ বিরোধী ঐক্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy