দুর্যোগ প্রকৃতির সৃষ্টি, কিন্তু দুর্ভিক্ষের স্রষ্টা মানুষ। আধুনিক জগতে বহু মানুষের অনাহারের পরিস্থিতি অকস্মাৎ উৎপন্ন হয় না। ভ্রান্ত, অপরিণামদর্শী নীতি হইতে দুর্ভিক্ষের উদ্ভব, তাহা বহু পূর্বে অমর্ত্য সেন প্রমুখ বিদ্বজ্জন দেখাইয়াছেন। কিন্তু তাহার পরেও অনাহার প্রতিরোধের উপায়গুলি উপেক্ষিত, প্রত্যাখ্যাত হইতেছে। সম্প্রতি রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব আন্তোনিয়ো গুতেরেস জানাইয়াছেন, বিশ্বের তিন কোটি মানুষ দাঁড়াইয়া দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি। অতিমারি ২৬ লক্ষ প্রাণ লইয়াছে, খাদ্যাভাবে তাহার অধিক মৃত্যু ঘটিতে পারে, এই সতর্কবার্তা পূর্বেই শুনাইয়াছিল রাষ্ট্রপুঞ্জ। তাহাতে কাজ হয় নাই, বিপন্নের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়িয়াছে। একবিংশ শতকের বিশ্বে খাদ্যশস্যের জোগান অপর্যাপ্ত, তৎসত্ত্বেও গত বৎসর ৬৯ কোটি মানুষ খাদ্যাভাবে বিপন্ন, আট কোটি মানুষ তীব্র ক্ষুধায় কষ্ট পাইয়াছেন। বিশ্বে ক্ষুধার্তের সংখ্যা কুড়ি শতাংশ বাড়াইয়াছে অতিমারি। এই বৎসর কোভিডে মৃত্যু কমিয়াছে, কিন্তু বাড়িয়াছে খাদ্যাভাব। অগণিত মানুষ দাঁড়াইয়া দুর্ভিক্ষ-সমতুল পরিস্থিতির চৌকাঠে। গত শতকে চল্লিশের দশকের বাংলায়, পঞ্চাশ-ষাট দশকের চিনে দুইটি ভয়ানক দুর্ভিক্ষ দেখিয়াছে বিশ্ব। দুইটি ক্ষেত্রেই অনাহারের প্রধান কারণ খাদ্যাভাব ছিল না। খাদ্যের সংগ্রহ ও বণ্টন সম্পর্কে যাঁহারা সিদ্ধান্ত লইয়াছিলেন, সেই নেতারা খাদ্যাভাবের তীব্রতার তথ্য পান নাই, অথবা পাইয়াও উপেক্ষা করিয়াছেন। গুতেরেস বলিয়াছেন, আজকের দুর্ভিক্ষও তৈরি হইয়াছে কৃত্রিম উপায়ে। ফসল উৎপাদন কম হয় নাই।
অনাহারে মৃত্যু তুচ্ছ হইতে পারে কখন? ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বাংলার খাদ্যশস্য পাঠাইয়াছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিকদের। চিনে মাও জে দং-এর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি দক্ষিণপন্থীদের নির্মূল করিতে নিযুক্ত ছিল। অর্থাৎ, সংঘাতের পরিস্থিতিতে খাদ্য নিরাপত্তা অবহেলিত হয়। রাষ্ট্রপুঞ্জের তথ্য অনুসারে, আজ বিশ্বের যে ৩৬টি দেশ দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন, তাহাদের অধিকাংশই দীর্ঘ দিন অশান্ত পরিস্থিতির মধ্য দিয়া চলিতেছে। সুদান, ইয়েমেন, কঙ্গো, আফগানিস্তান প্রভৃতি যে দেশগুলি দীর্ঘ দিন ধরিয়া যুদ্ধ ও অভ্যন্তরীণ সংঘাতে দীর্ণ, সেগুলিতে আজ ক্ষুধা করাল রূপ লইয়াছে। খাদ্যাভাবের জন্য সংঘাত, এবং সংঘাতের জন্য খাদ্যাভাব, এই দুষ্টচক্র চলিতেছে। ক্ষুধার্ত মানুষকে রসদ না জুগাইলে কার্যত সংঘাতকেই রসদ জোগানো হইবে।
এই কথাটি কি ভারতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য নহে? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দুর্ভিক্ষের উদ্ভব হইতে পারে না, কিন্তু অর্ধাহার, অপুষ্টির নীরব মহামারি চলিতে থাকে। তাহাকে অস্বীকার করিয়া রাষ্ট্র তাহাকে দীর্ঘায়িত করে। ২০২০ সালে বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারতের স্থান ছিল ১০৭টি দেশের মধ্যে ৯৪— পাকিস্তান, নেপাল, ইন্দোনেশিয়াও স্থান পাইয়াছে ভারতের আগে। এক দিকে প্রচুর উদ্বৃত্ত ধান-গম, অপর দিকে ক্ষুধার্ত মানুষ, এই পরিস্থিতিকে ক্রমাগত উপেক্ষা করিয়াছে ভারত। শিশু অপুষ্টি, নারীদের রক্তাল্পতা গত পাঁচ বৎসরে বাড়িয়াছে। লকডাউনে বহু পরিবার দৈনন্দিন খাদ্যের পরিমাণ কমাইয়াছিল। আজও ব্যাপক বেকারত্বের জন্য ক্ষুধাপীড়িত দিন কাটাইতেছে অগণিত মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে কেন্দ্র কী করিতেছে? আধার সংযুক্তি না হইবার জন্য অন্তত তিন কোটি রেশন কার্ড বাতিল করিয়াছে কেন্দ্র, সুপ্রিম কোর্ট তাহার কারণ জানিতে চাহিয়াছে। খাদ্যের অধিকার আইনের অন্তর্ভুক্ত রেশন প্রাপকদের অনুপাত কমাইবার প্রস্তাবও বিবেচনা করিতেছে। ইহাই কি খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করিবার উপায়? ক্ষুধা নিবারণের চেষ্টা হইতেই মানবসভ্যতার সূচনা। তাহাকে তুচ্ছ করা অ-মানবিক। রোজগার নিরাপত্তা ও খাদ্য নিরাপত্তা, এই দুইটি নিশ্চিত করিবার দায়িত্ব সর্বাগ্রে পালন করিতে হইবে সকল স্তরের সরকারকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy