মিখাইল গর্বাচভ।
সমাজতন্ত্রের মৃত্যুঘণ্টা বাজল: উনিশশো আশির দশকের সমাপনকালে এমনই মনে করা হয়েছিল। সে বড় সুখের সময় ছিল কি না, আজও অনেকের মতেই তা একটি বিতর্কিত প্রশ্ন। কিন্তু ঘণ্টাটি বাজিয়ে এক যুগাবসানের সূচনা যিনি করেছিলেন, তাঁর নাম যে মিখাইল গর্বাচভ, এ নিয়ে সন্দেহ নেই। গত বুধবার বিরানব্বই বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু আবার মনে করিয়ে দিল যে, একক ব্যক্তির পক্ষে কত বড় ঐতিহাসিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া সম্ভব, তার সর্বকালীন তালিকায় তাঁর নামটি থেকে যাবেই। অনেকে প্রশ্ন তুলবেন, এ কি কারও একার কাজ? ইতিহাসবোধ বলে, কোনও মানুষের কাজই তার একার কাজ নয়, সময় ও প্রেক্ষিতই ব্যক্তি ও তার ভূমিকাকে অনেকাংশে নির্মাণ করে। সমাজতন্ত্রের মৃত্যুপ্রহর নিশ্চয়ই ঘনিয়ে আসছিল, অলক্ষ্যে, পরোক্ষে। তবে কুরুক্ষেত্রে যেমন শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন ‘নিমিত্তমাত্র ভব সব্যসাচিন্’, আশির দশকের শেষের সোভিয়েট ইউনিয়নে সেই নিমিত্তের ভূমিকাটি পালন করতে নেমেছিলেন তৎকালীন সোভিয়েট ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট গর্বাচভ। গ্লাসনস্ত-এর খোলা হাওয়া কিংবা পেরেস্ত্রৈকা-র পুনর্গঠন পরিকল্পনা কেবল তাঁরই একক নিজস্ব কৃতিত্ব না হতে পারে, কিন্তু বিংশ শতাব্দীর প্রচলিত সমাজতন্ত্রের বদ্ধতার অবসান ঘটানোর প্রত্যক্ষ ‘গৌরব’টি তবুও তাঁর একার। সে দিক দিয়ে তাঁকে বলাই যায় চার দশকের ঠান্ডা যুদ্ধের অবসানের সূচনাকারী— অতঃপর সোভিয়েট ইউনিয়ন রাশিয়ায় পরিণত হল, দুই জার্মানি মিলিত হয়ে এক দেশ হয়ে গেল, ইউরোপে খোলা হাওয়া বয়ে গেল, আমেরিকার সঙ্গে প্রাক্তন সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার সংঘাত কমল— প্রকৃতপক্ষে, এক বিরাট লৌহযবনিকা উঠে যাওয়ার ফলে সমগ্র বিশ্বপৃথিবীর জন্যই স্থিতাবস্থা যেন পাল্টে গেল।
গর্বাচভ নির্বাচনে দাঁড়ালে রাশিয়া ছাড়া যে কোনও দেশেই হয়তো তিনি জিতে যেতেন। সোভিয়েট-পতনের পর নতুন রাশিয়ায় গর্বাচভ গৌরবান্বিত নায়ক হতে পারেননি, হওয়ার চেষ্টাও করেননি। অনেক রাষ্ট্রনায়কের তুলনায় তাঁর ভূমিকাটি ছিল উল্লেখযোগ্য ভাবে স্বার্থবোধহীন। কমিউনিস্ট পার্টির কট্টরবাদী শিবির অভ্যুত্থান ঘটিয়ে তাঁকে বন্দি করতে চেয়েছিল। তাঁর রাজনৈতিক পতনও এসেছে অতি দ্রুত, সোভিয়েট ইউনিয়ন ভেঙে টুকরো হওয়ার অভিঘাতে তাঁকে সরিয়ে দিতে চেয়েছে ক্ষমতাবৃত্ত। অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জেরও তিনি মোকাবিলা করতে পারেননি। কিন্তু বরিস ইয়েলৎসিন-সহ সমস্ত রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ও বিরোধীকে গর্বাচভ যথেষ্ট মান্য করে এসেছেন, কখনও সৌজন্যের অভাব দেখাননি— এ কথাটি কম গুরুতর নয়, বিশেষত আজকের প্রেক্ষাপটে, রাজনীতিতে সৌজন্যের দাম যখন কমেই চলেছে।
গর্বাচভের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা নিশ্চয়ই এই যে, মুক্ত বাতাসের ভরসাতেই তিনি সংস্কার চালু করেছিলেন, কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত রাশিয়ায় প্রবাহিত হতে পারেনি। পারেনি যে, তার কারণ সংস্কারের পদ্ধতিটি ছিল মূলত চাপিয়ে দেওয়া, ভিতর থেকে তৈরি করা নয়; সেই সংস্কারকে সার্থক করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানের ঘাটতিও রাশিয়ার উত্তরণের পথে দুস্তর বাধা সৃষ্টি করেছিল, যে বাধা আজও বিপুল। যে অভিমুখে সেই দেশের হাঁটার কথা ছিল ১৯৯০-৯১ সালের পর, সে দিকে হাঁটা এখনও তার হয়নি। প্রেসিডেন্ট পুতিনের রাশিয়ায় তাই আবার সেই সোভিয়েটেরই ছায়া এবং কায়া, হয়তো আরও কঠিন এবং ভয়ানক রূপে। কিন্তু ইতিহাস তো একমুখী নয়— অনেক ঘূর্ণ্যমান পথে তা প্রবাহিত হয়। মস্কো যদি পরিবর্তনের পথ ধরতে না-ও পেরে থাকে, সে পথের মূল্য মিথ্যা হয়ে যায় না: হয়তো বার্লিন, প্রাগ, টিবলিসি, সারাইয়েভোরা তা অনেকাংশে পেরেছে। কত দাম দিয়ে সেই নতুন পথ অর্জন করতে হয়েছে, বর্তমান প্রজন্ম তা বিস্মৃত হলেও পাস্তেরনাক আর সলঝেনিৎসিনরা তা জানেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy