—প্রতীকী ছবি।
সমস্যামাত্রেই রহস্য নয়। যখন সমস্যার কারণ বা উৎস সহজে বোঝা যায় না, তখনই রহস্যের জন্ম হয়। রহস্য গভীর হয়ে ওঠে, যখন সমস্যাটি ঠিক কী, সেটাই অস্পষ্ট থেকে যায়। কিছু নাগরিকের আধার কার্ড ‘নিষ্ক্রিয়’ হয়ে পড়ার বার্তাকে কেন্দ্র করে গত কয়েক দিন যাবৎ যে বিভ্রান্তির কুপবন প্রবাহিত হয়ে চলেছে, তা এই মৌলিক অর্থেই রহস্যময়। এই রহস্যে মিশে আছে সংশয় এবং আশঙ্কা। পরিচিতি তথা নাগরিকত্ব হারানোর বা বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা। এই বিষয়ে সমাজমাধ্যমে শোরগোল ওঠার পরে আধার ব্যবস্থার পরিচালকরা আশ্বাস দিয়েছেন যে এই নিয়ে উদ্বেগের কারণ নেই, কিন্তু সেই আশ্বাস আপাতদৃষ্টিতে যথেষ্ট জোরদার নয়— ‘প্রযুক্তিগত বিভ্রাট’ বা অনুরূপ ব্যাখ্যায় আজ আর মানুষের বিভ্রান্তি দূর হয় না, বরং ভয় হয়, কুটিল রাষ্ট্রীয় বা রাজনৈতিক অভিসন্ধিকে এমন ব্যাখ্যার আড়ালে লুকিয়ে রাখা হচ্ছে না তো?
এই আশঙ্কার বিলক্ষণ হেতু আছে। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাগ্ধারা অনুসারে বলা চলে, প্রধান হেতুটির নাম ‘ক্রোনোলজি’, অর্থাৎ ঘটনাপরম্পরা। লোকসভা নির্বাচন কাছে আসার সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীয় শাসক দলের শিবির থেকে পশ্চিমবঙ্গে নাগরিকত্ব সংক্রান্ত নতুন বিধিব্যবস্থা চালু করার হাঁকডাক শোনা গিয়েছে, সেই নির্ঘোষে নেতৃত্ব দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে। চেনা ছক ধরেই এই তৎপরতার প্রধান লক্ষ্য হিসাবে চিহ্নিত হয়েছেন মতুয়া গোষ্ঠীর মানুষ, যে গোষ্ঠীকে নিয়ে দলীয় রাজনীতির টানাটানির দীর্ঘ ইতিহাসে নাগরিকত্বের প্রশ্নটি সাম্প্রতিক কালে উত্তরোত্তর প্রবল আকার ধারণ করেছে। লক্ষণীয়, এই বাস্তবের প্রেক্ষাপটে আধার নিষ্ক্রিয় করার বার্তা বিজেপির নির্বাচনী রাজনীতিতেও সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে— মতুয়া গোষ্ঠীর মানুষ আধার-বার্তায় শঙ্কিত হয়ে উঠলে তা নিশ্চয়ই দলের পক্ষে স্বস্তিকর নয়। সম্ভবত এই বিপদের আঁচ পেয়েই কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকদের, বিশেষত মতুয়াদের আশ্বাস দিতে মাঠে নেমেছে, তাদের গোষ্ঠীভুক্ত সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সেই অভয়বার্তার ‘মুখপাত্র’ হয়েছেন। অন্য দিকে, মুখ্যমন্ত্রী আধারের ‘বিকল্প’ পরিচিতিপত্র চালু করে পাল্টা অভয়বার্তা দিতে তৎপর হয়েছেন। রাজ্য সরকারের শংসাপত্র কী ভাবে আধারের বিকল্প হতে পারে, সেই প্রশ্নের উত্তর প্রশাসনিক বা আইনি যুক্তিতে খুঁজে লাভ নেই, সেই উত্তর নিহিত আছে প্রতিযোগিতার রাজনীতিতে। বস্তুত, সেই রাজনীতির মন্ত্রণাতেই আধার আপাতত এক দুর্জ্ঞেয় রহস্যের প্রকরণ হয়ে উঠেছে।
আধার-বার্তা রহস্য আপাতত দুর্জ্ঞেয় হলেও একটি বৃহত্তর সত্য সুস্পষ্ট। আধারের এই পরিণতি ভারতীয় রাজনীতির মৌলিক অবনমনের একটি নজির। দ্বিতীয় ইউপিএ জমানার শুরুতে যখন দেশের অধিবাসীদের একটি ‘ইউনিক’ বা অদ্বিতীয় পরিচিতির আয়োজন শুরু হয়, তখন সেই অ-দ্বিতীয়তার অর্থ ছিল না আবশ্যিকতা। বরং লক্ষ্য ছিল বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের সুযোগসুবিধা যাতে এই পরিচিতির মাধ্যমে মানুষের কাছে যথাযথ ভাবে পৌঁছনোর সুব্যবস্থা করা। অতঃপর এই ‘সহায়ক’ আয়োজনটি একটি ‘নজরদারি’র প্রকরণে পরিণত হয়েছে। আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে আধারকে অস্বাভাবিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, এমনকি আধার-সংযোগ কার্যত বাধ্যতামূলক করে তোলা হয়েছে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নাগরিকদের ব্যক্তিগত পরিসরে সরকারি (এবং অন্যবিধ) নজরদারির আশঙ্কাও ক্রমশই প্রবল হয়ে উঠেছে। আধার-পরিচিতির সঙ্গে নাগরিকত্বের মৌলিক প্রশ্নটিকে জড়িয়ে ফেলার সাম্প্রতিক লক্ষণগুলি এই ইতিহাসেরই পরবর্তী অধ্যায়। কেন্দ্র এবং রাজ্য, দুই স্তরেরই রাজনীতিকদের দায়িত্ব এই ইতিহাসের চাকা ঘোরানো, আধার নামক আয়োজনটিকে রাজনীতির আবর্ত থেকে মুক্ত করে পরিষেবার সহায়ক হিসাবেই তার সদ্ব্যবহার করা। নির্বাচনী রাজনীতির ঘোলা জলে মাছ ধরতে উন্মুখ রাজনীতিকরা সেই দায়িত্ব পালন করবেন, এমন আশা অবশ্য দুরাশামাত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy