Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
D.Y. Chandrachud

অ-মর্যাদা

প্রকৃত গণতন্ত্র আজও সুদূরপরাহত। হয়তো সে ক্রমেই সুদূরতর হবে, মর্যাদা-হত্যা আদি অনুশাসনের দাপট বেড়েই চলবে। ‘অমৃত কাল’-এ বুঝি বা এমনটাই হওয়ার কথা।

ভারতের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়।

ভারতের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়। ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০২২ ০৬:৩৩
Share: Save:

সমাজে যাদের আধিপত্য, তাদের ধ্যানধারণাই সমাজে আধিপত্য বিস্তার করে। কথাটা পুরনো, এবং কালজয়ী। ভারতের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় সম্প্রতি ‘আইন ও নৈতিকতা’ বিষয়ক এক বক্তৃতায় এই মূল্যবান সত্যটিকেই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, দুর্বল তথা প্রান্তিক মানুষ সমাজে বেঁচে থাকার তাগিদেই ক্ষমতাবান উচ্চবর্গের তৈরি করে দেওয়া ‘নৈতিকতা’র অনুশাসন মেনে চলতে বাধ্য হন, নিজস্ব কোনও প্রতিস্পর্ধী নৈতিকতা বা নীতিকে সামাজিক পরিসরে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন না, করতে চাইলে তাঁদের কঠোর ভাবে দমন করা হয়। উচ্চকোটির নৈতিক আধিপত্যের পরিচয় দিতে গিয়ে তিনি এ দেশে সমকাম দমনের দীর্ঘপ্রচলিত রীতি, ডান্স বার-এর উপর নিষেধাজ্ঞা, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ককে অপরাধ বলে গণ্য করার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, দক্ষিণ ভারতের কোনও কোনও অঞ্চলে ‘নিচু জাত’-এর মেয়েদের বক্ষ উন্মুক্ত না রাখলে কর আদায়ের প্রথা ইত্যাদি নানা দৃষ্টান্তের উল্লেখ করেছেন। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সমাজের ক্ষমতাবানেরা নৈতিক-অনৈতিকের সংজ্ঞা নির্ধারণ করেন, যে বিধান অমান্য করলে শাস্তি পেতে হয়। এই শাস্তির এক চরম এবং বহুলপ্রচলিত নজির হল ‘অনার কিলিং’ বা মর্যাদা-হত্যা। প্রধান বিচারপতি মনে করিয়ে দিয়েছেন, ভারতে শত শত তরুণ-তরুণী ভিন্ন জাতের কাউকে ভালবাসার অপরাধে, পরিবারের ইচ্ছার বাইরে যাওয়ার অপরাধে নিহত হন। মর্যাদার এই বিকট সংজ্ঞাই আজও আধিপত্য চালাচ্ছে, কারণ ক্ষমতাবানেরা সেই সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছেন।

লক্ষণীয়, ক্ষমতার এই দুঃশাসন কেবল দুর্বল বা প্রান্তিক বর্গের মানুষকেই পীড়ন করে না, উচ্চবর্গের মধ্যে থেকেও যদি কোনও ব্যক্তি তার সামাজিক অনুশাসন লঙ্ঘন করতে চান, তাঁর উপরেও সেই পীড়ন নেমে আসে— ক্ষমতাবান উচ্চকোটির পরিবারে বা গোষ্ঠীতে কারও সমকামী প্রবণতা জানাজানি হলে অথবা কেউ ভিন্ন জাতের মানুষকে ভালবাসলে তাকে প্রায়শই চরম দণ্ড ভোগ করতে হয়; বস্তুত, মর্যাদা-হত্যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উঁচু জাতের সুকীর্তি। এখানেই রাষ্ট্রের ভূমিকা বিশেষ ভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। ভারতের মতো দেশে সমাজ আজও সচরাচর ব্যক্তির নিজের মতো বাঁচার অধিকারকে— সম্মান দূরের কথা— স্বীকারই করে না। ভারতীয় সংবিধানে নাগরিকের অধিকারের ধারণাটিকে ব্যক্তির স্বাধীন ও সক্ষম জীবনযাপনের মৌলিক আদর্শের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করার পিছনে এই সামাজিক বাস্তবতার সুস্পষ্ট স্বীকৃতি ছিল। সেই সময় যাঁরা গোষ্ঠী বা কৌমের অধিকারকে গুরুত্ব দিতে চেয়েছিলেন, আম্বেডকর বা নেহরুর মতো নীতিকাররা তাঁদের বিপরীত অবস্থান নিয়েছিলেন। তাঁদের প্রধান যুক্তি ছিল, বৈষম্যপ্রধান সমাজে গোষ্ঠীতন্ত্র ক্ষমতার আধিপত্যকেই বহাল রাখবে, সেই আধিপত্য ভেঙে নাগরিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের লক্ষ্য। গভীর দুঃখ এবং উদ্বেগের কথা এটাই যে, সংবিধান প্রবর্তনের সাত দশক অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও ভারতীয় রাষ্ট্র সেই লক্ষ্য পূরণে অনেকাংশেই ব্যর্থ। প্রধান বিচারপতিও বলেছেন যে, উচ্চকোটির দাপটে পীড়িত দুর্বল এবং প্রান্তিক মানুষদের সরকারও কোণঠাসা করে রাখে। প্রকৃত গণতন্ত্র আজও সুদূরপরাহত। হয়তো সে ক্রমেই সুদূরতর হবে, মর্যাদা-হত্যা আদি অনুশাসনের দাপট বেড়েই চলবে। ‘অমৃত কাল’-এ বুঝি বা এমনটাই হওয়ার কথা।

অন্য বিষয়গুলি:

D.Y. Chandrachud Supreme Court Law
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy