অবশেষে ব্রাহ্মমুহূর্ত আসিয়া পড়িল কি? আমেরিকার সেন্টারস ফর ডিজ়িজ় কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) জানাইয়াছে, দুই ডোজ় টিকা সম্পূর্ণ হইলে অতিমারি-পূর্ব জীবনে প্রত্যাবর্তন করা যাইবে— মাস্ক পরিতে হইবে না এবং দূরত্ববিধিও অহেতুক। সিডিসি নিশ্চয়ই বিজ্ঞানের ভিত্তিতে গৃহীত সিদ্ধান্ত জানাইয়াছে, কিন্তু সমাজের ভিত্তিতে তাহা কী ভাবে মানা হইবে, সেই প্রশ্ন বোধ করি ঈষৎ জটিলতর। এবং তাহার উত্তর সন্ধানে ভ্রমের অবকাশও প্রভূত। ভ্রম দুই প্রকারের। প্রথম প্রকারের ভুল— যাহা করিবার নহে, তাহা করা। যেমন, মুখাবরণী পরিবার প্রয়োজন নাই, তথাপি তাহা পরিধান করা। দ্বিতীয় গোত্রের ভ্রম— যাহা করিবার, তাহা না করা। অর্থাৎ, মুখাবরণী পরিবার প্রয়োজন থাকিলেও তাহা পরিধান না করা। দুইয়ের ভিতর কোন ভ্রমটি নিরাপদ, সুতরাং শ্রেয়, তাহার অধিক ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। সিডিসি-র বিজ্ঞানীরা নিশ্চয়ই গবেষণালব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে মন্তব্য করিতেছেন, কিন্তু ভবিষ্যতে যদি তথ্যই পাল্টাইয়া যায়? যে ব্যক্তিগণ তাঁহাদের পরামর্শে মাস্ক ত্যাগ করিলেন তাঁহাদের কী হইবে? তদুপরি কোনও টিকার সুরক্ষা-শক্তিই একশত শতাংশ নহে, প্রত্যেকের দেহে তাহা ভাইরাস প্রতিরোধ করিবে না। সর্বোপরি ভাইরাসের চরিত্র বদল ঘটিতে পারে, বস্তুত ঘটিয়া চলিতেছে। সুতরাং, সিডিসি-কে মাথায় রাখিয়া বলা দরকার: নাগরিক সাবধান।
প্রশ্নটি সামাজিক অভ্যাসেরও। মুখমণ্ডল আবৃত করিয়া রাখিবার কঠিন ও কষ্টার্জিত অভ্যাসের শৃঙ্খলা এক বার ত্যাগ করিলে ভবিষ্যতে তাহা ফিরাইয়া আনা কঠিনতর। ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাবের প্রথম পাদেই মুখ ঢাকিবার শৃঙ্খলার বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের বিক্ষিপ্ত গর্জন শুনা গিয়াছিল। আশঙ্কা হয়, বারংবার সিদ্ধান্ত পাল্টাইলে সেই গণতন্ত্র ক্রমশ সংগঠিত যথেচ্ছাচারে পরিণত হইবে। কেহ নিয়ম মানিতে হেলাফেলা করিবেন, কেহ এক ধাপ উচ্চে উঠিয়া বিজ্ঞানের দোহাই পাড়িলেও আশ্চর্যের নহে। বিজ্ঞান নিশ্চয়ই প্রয়োজনে আত্মসংশোধন করিতে বলে। সমস্যা হইল, বিজ্ঞানের নিয়ম জনতা বুঝে না। মুখাবরণী না পরিবার পরামর্শ ভ্রান্ত প্রমাণিত হইলে বিজ্ঞান আপনার যথার্থ পথ অন্বেষণে নূতনতর গবেষণায় ব্যাপৃত হইবে, কিন্তু তাহার মূল্য গনিতে হইবে মানুষকে, যাঁহারা সেই পরামর্শে আস্থা রাখিয়াছিলেন।
বস্তুত, বিজ্ঞানের সহিত সমাজের সম্পর্কটি পুনরন্বেষণের সুযোগ করিয়া দিয়াছে এই অতিমারি। রাষ্ট্রপুঞ্জ বিজ্ঞানকে ‘সর্বোৎকৃষ্ট সম্মিলিত প্রচেষ্টা’ বলিয়া থাকে। কেবল চিকিৎসাবিজ্ঞানেই তাহার প্রভূত সামাজিক অবদান— দীর্ঘ ও সুস্থ জীবন নিশ্চিত করা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করা, রোগ নিরাময়ে ঔষধ প্রস্তুত করা, ব্যথা-বেদনার উপশম করা। ব্রহ্মাণ্ডের বিবিধ বৃহৎ ধাঁধার জবাব খুঁজিবার চেষ্টা না করিলে দৈনন্দিন জীবনে এহেন সমাধান উপস্থিত করা সম্ভব নহে। বিজ্ঞান, অতএব, জ্ঞানের উপায়। যে জ্ঞান সমাজকে আলোকিত করে— আরও তথ্যে, শিক্ষায়, জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই বলা যায় যে, প্রশাসনকে যেমন স্বাস্থ্য বা কৃষিক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভিত্তিতে নীতি লইতে হইবে, বিজ্ঞানকেও তেমনই সামাজিক পরিবর্তনগুলি বিচার করিতে হইবে। দুই অভিমুখে এই আদানপ্রদান চলিলে তবেই বিজ্ঞান সামাজিক মানুষের যথার্থ হাতিয়ার হইয়া উঠিবে। প্রশাসন আপনার সুবিধার্থে বৈজ্ঞানিক তথ্য গোপন করিলে যেমন বিপদ, বিজ্ঞানী সামাজিক ফল না ভাবিয়া কোনও মন্তব্য করিলে তেমনই বিপদ। বিজ্ঞান নিশ্চয়ই আপন বেগে চলিবে, তাহাতে বাহির হইতে বাধা আসিলে চলিবে না। কিন্তু তাহাকে সমাজের সহিত আলাপের বাস্তবটি স্মরণে রাখিতে হইবে। বিজ্ঞানের সহিত সমাজের কথোপকথনে যেন কাণ্ডজ্ঞানের অভাব না ঘটে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy