কমলাকান্ত চক্রবর্তীর জাতি-পরিচয় জিজ্ঞাসা করে উকিল খুব বিপদে পড়েছিলেন। তাঁকে বেশ কিছুক্ষণ নাস্তানাবুদ করার পরে শেষ পর্যন্ত কমলাকান্ত উকিলকে বোকা বানিয়ে বলেন— পদবি চক্রবর্তী, গলায় যজ্ঞোপবীত, তবু তিনি জানতে চাইছেন, ‘তুমি কী জাতি’! কিন্তু ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিমচন্দ্র বিলক্ষণ জানতেন যে, উকিলের দোষ ছিল না, ব্রিটিশ রাজের আইনে রাষ্ট্রের দরবারে সেই পরিচয় স্পষ্ট করে ঘোষণা আবশ্যক ছিল। ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটলে নিয়ম বদলায়, কারণ রাষ্ট্রের চালকরা মনে করেছিলেন, জাতি-পরিচয়ের হিসাব নেওয়া চলতে থাকলে জাতপাতের বিভাজন প্রশ্রয় পেতে থাকবে। এই ধারণার বশেই স্বাধীন ভারতে জনগণনায় ‘কাস্ট’-এর নথিভুক্তি বন্ধ হয়ে যায়। ধারণাটা অহেতুক বা অযৌক্তিক ছিল না, বরং সেটি ছিল এক মহান আদর্শের সূচক, যে আদর্শ স্থির করেছিল— জাতের নামে বজ্জাতির দীর্ঘ ঐতিহ্য পিছনে ফেলে আধুনিক ভারতের উদয়ের পথে এগিয়ে যেতে হবে, সেই পথের যাত্রীদের গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র জিজ্ঞাসা করবে না, ‘তুমি কী জাতি?’
পরবর্তী ইতিহাস জানিয়ে দিয়েছে, আদর্শ মহান হলেও বাস্তব তার অনুসারী হয়নি, বরং তাকে উত্তরোত্তর প্রভাবিত করেছে, তাকে বাঁকিয়ে-চুরিয়ে দুমড়ে-মুচড়ে এক বিচিত্র ব্যবস্থা তৈরি করেছে, যেখানে জাতপাত কেবল জীবন্ত নয়, প্রবল ও পরাক্রমী। এক দিকে সমাজের বিস্তীর্ণ পরিসরে, এমনকি তথাকথিত আধুনিক নাগরিক পরিসরেও, নানা ভাবে জাতের বিচার অব্যাহত; শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান তথা অর্থনৈতিক সুযোগসুবিধার বণ্টনে জাত-ভিত্তিক বৈষম্যের প্রচণ্ড প্রভাব অত্যন্ত স্পষ্ট— অতি সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রম দফতর প্রকাশিত নথিপত্রেও সেই বৈষম্যের দগদগে ছবি ফুটে উঠেছে। অন্য দিকে, সংরক্ষণের দুর্মর এবং ক্রমশ প্রসরণশীল কাঠামোটিকে কেন্দ্র করে জাতপাতের অঙ্ক হয়ে উঠেছে রাজনীতির এক শক্তিশালী হাতিয়ার। বস্তুত, নির্বাচনী রাজনীতির পরিসরে আজ যে ভাবে জাতপাতের জটিল হিসাবনিকাশ কষা হয়ে থাকে, সাত দশক আগের জাত-ভিত্তিক রাজনীতি তার তুলনায় অনেক বেশি সরল ছিল।
এই পরিপ্রেক্ষিতেই জনশুমারিতে জাতের হিসাব নেওয়ার রীতি নতুন করে প্রবর্তনের দাবি ক্রমশ জোরদার হয়ে উঠছে। প্রত্যাশিত ভাবেই সেই দাবি ঘোষণায় নেতৃত্ব দিচ্ছে এমন কিছু রাজনৈতিক দল, যারা জাতি-পরিচয় ভিত্তিক রাজনীতি করেই উঠে এসেছে এবং আজও সেই রাজনীতি যাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকায় আছে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি বা ওবিসি-প্রধান দলগুলি। এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যে, শাসক এনডিএ-র সদস্য তথা বিজেপির শরিক নীতীশ কুমারের জেডিইউ এই দাবির সরব সমর্থক। স্পষ্টতই, জাতি-পরিচয়ের গুরুত্ব শাসক-বিরোধী বিভাজনের সীমারেখা ভেঙে দিচ্ছে। আবার, তৃণমূল কংগ্রেসের মতো অন্য কয়েকটি দলও জাত-গণনার দাবিতে সুর মিলিয়েছে। অর্থাৎ, জাত-গণনার দাবি আজ আর কেবল ‘আইডেন্টিটি পলিটিক্স’ বা পরিচিতির রাজনীতির নির্দিষ্ট শিবিরে সীমিত নেই। অন্য ভাবে বললে, পরিচিতির রাজনীতিই তার পুরনো ‘স্বভূমি’র সীমা অতিক্রম করে বৃহত্তর পরিধিতে প্রসারিত। এই প্রক্রিয়া নতুন নয়। অখণ্ড হিন্দুত্বের ‘কমণ্ডলু’ দিয়ে রাজনীতির মণ্ডলায়নকে প্রতিহত করার পুরনো প্রকল্প থেকে বিজেপিও অনেকটা সরে এসেছে। সর্বগ্রাসী হিন্দুত্ব আজও তার ব্রহ্মাস্ত্র, কিন্তু তার রণকৌশলেও জাতপাতের ভূমিকা গুরুতর। সেই কারণেই জাত-শুমারির দাবির মোকাবিলা করা নরেন্দ্র মোদীর পক্ষে সহজ কাজ নয়। অথচ, জাতপাতের নতুন হিসাব কষার রাস্তা খুলে দিলে মণ্ডল-রাজনীতির পক্ষে জোরদার হাওয়া উঠতে বাধ্য, সেই হাওয়া বিজেপির অনুকূল হতে পারে না। অর্থাৎ, উভয়সঙ্কট।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy