—ফাইল চিত্র।
জড়িয়ে গেছে সরু মোটা দুটো তারে, জীবনবীণা ঠিক সুরে তাই বাজে না রে। ২০১০ সাল থেকে ওবিসি শংসাপত্র বাতিল করে অতি সম্প্রতি যে রায় দিয়েছে কলকাতা হাই কোর্ট, তার পর থেকে রাজ্য জুড়ে রাজনীতির ঘূর্ণিপাক মনে করাচ্ছে রবীন্দ্রনাথের এই পঙ্ক্তিটি। নির্বাচনের মাত্র কিছু প্রহর অবশিষ্ট, এমন সময়ে ভোটের প্রচারে এসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর স্বভাবসিদ্ধ দাপটের সঙ্গে জানিয়ে দিচ্ছেন, হাই কোর্টের নির্দেশ তিনি কিছুতেই মানবেন না, সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে লড়বেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অন্য প্রচার-মঞ্চে ততোধিক দাপটের সঙ্গে ঘোষণা করছেন, হাই কোর্টের এই রায় বিরোধী নেতৃত্বের গালে একটি ‘বিশালাকার চপেটাঘাত’— মুসলিম তোষণের শেষ দেখেই তাঁরা ছাড়বেন। পশ্চিমবঙ্গে গত দশকে ওবিসি শংসাপত্রের সিংহভাগই যে-হেতু মুসলমানদের কাছে গেছে, মুসলমান গোষ্ঠীদেরই ওবিসি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, বুঝতে অসুবিধা হয় না ভোটের এই শেষবেলায় দুই নেতানেত্রী কেন বিষম দাপটের প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। কেউ সংখ্যালঘু তোষণের বিরোধিতাকে ভোটের মোক্ষমতম চাল করে নিয়েছেন। কেউ বা দেখাতে চাইছেন, রাজ্যে সংখ্যালঘুর ‘উন্নয়ন’-এর প্রতিশ্রুতি থেকে ভোটের আগে গলার স্বর এক পর্দাও খাদে নামানো যাবে না। ওবিসি শংসাপত্র বস্তুটি বিশেষ জরুরি একটি সামাজিক ন্যায় কার্যক্রম, অথচ তা শেষ পর্যন্ত এমন সস্তা ভোটযুদ্ধের অস্ত্রে পরিণত হল।
পশ্চিমবঙ্গে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি বা ওবিসির জন্য যে ১৭ শতাংশ সংরক্ষণ আছে, তাতে দু’টি ভাগ, ‘ক’ ভাগে (১০ শতাংশ) ৮১ গোষ্ঠীর মধ্যে ৫৬টি মুসলমান গোষ্ঠী, এবং ‘খ’ ভাগে (৭ শতাংশ) ৯৯ গোষ্ঠীর মধ্যে ৪১টি মুসলমান গোষ্ঠী। এই কাজ শুরু হয় যখন এ রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার ২০১০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি মুসলমানদের জন্য ১০ শতাংশ সংরক্ষণের কথা ঘোষণা করে। ছয় মাসের মধ্যে ওবিসি হিসাবে ৪২টি গোষ্ঠীর নাম প্রস্তাবিত হয়, যার মধ্যে ৪১টি মুসলমান গোষ্ঠী। ২০১২ সালে এই সংক্রান্ত আইনটি বিধানসভায় পাশ হয়, পরবর্তী কালে তৃণমূল সরকারের তত্ত্বাবধানে দ্রুত এগোতে থাকে ওবিসি তালিকার সংশোধন। ২০২৩ সালে তালিকায় ১৭৯টি গোষ্ঠীর মধ্যে ১১৮টি ছিল মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত। অনগ্রসর কল্যাণ দফতর থেকে তৃণমূল সরকারের আমলে যত শংসাপত্র প্রদান করা হয়েছে, অন্তত দেড় কোটি, তার সত্তর শতাংশেরও বেশি পেয়েছেন মুসলমানরা। জাতীয় অনগ্রসর জাতি কমিশন এ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বিরুদ্ধে, এবং মোদী সরকার এ রাজ্যের তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে তোষণের অভিযোগ তুলে চলেছে। তবে কাজটি শুরু হয়েছিল বাম আমলেই, তাই হাই কোর্টের রায়ের পর কেবল তৃণমূল কংগ্রেস নয়, বাম ও কংগ্রেস-সহ সমগ্র বিরোধী ফ্রন্ট ‘ইন্ডিয়া’ই মোদীর আক্রমণের লক্ষ্য।
অনগ্রসর শ্রেণির মধ্যে ধর্মভিত্তিক সম্প্রদায় পড়তে পারে কি না, এই আলোচনা এই প্রথম হচ্ছে না। গত শতাব্দীর শেষ থেকে বারংবার বিষয়টি জাতীয় মঞ্চে এসেছে, কর্নাটক, কেরল, অন্ধ্রপ্রদেশ, এবং পরে তেলঙ্গানায় এ নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক হয়েছে। যুক্তি শোনা গিয়েছে, ধর্মের ভিত্তিতে দেশের সম্পদ বাঁটোয়ারা করা চলে না। প্রতিযুক্তিও উঠে এসেছে যে ধর্মের ভিত্তিতে অনগ্রসরতার মধ্যে বৈষম্য করা অনুচিত বলেই মুসলমানদের সংরক্ষণের আওতা থেকে বাদ দেওয়া অসঙ্গত। যদি অত্যধিক মুসলমান গোষ্ঠীকে ওবিসি তালিকায় ঢোকানো হয়ে থাকে, তার তদন্ত ও বিবেচনা গোষ্ঠীভিত্তিকই হওয়া উচিত, অর্থাৎ কোন মুসলমান সত্যই পশ্চাৎপদ, কে নয়, তার বিচারে। মূল কথা, এটি একটি জরুরি বিতর্ক। অথচ বিতর্কটিকে অতি-তরলায়িত করে সংখ্যালঘু-বিদ্বেষের রাজনীতিতে পরিণত করা হল মোদী জমানায়। ভোটবাজারের চাপান-উতোরকে অতিক্রম করেই বুঝতে হবে, যুক্তি ও প্রতিযুক্তির প্রকৃত ওজন কী ও কতখানি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy