কলিকাতায় পঁচিশ বছর আগে সত্যজিৎ রায় স্মারক বক্তৃতা দিয়াছিলেন অধ্যাপক অমর্ত্য সেন। সেই বক্তৃতার শিরোনাম ছিল: আওয়ার কালচার দেয়ার কালচার। আমাদের সংস্কৃতি, তাহাদের সংস্কৃতি। বাংলা, ভারত তথা প্রাচ্যের সহিত পশ্চিম দুনিয়ার সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের বিষয়টিকে এই উপলক্ষে নির্বাচন করিবার পিছনে এক দিকে ছিল বক্তা অমর্ত্য সেনের নিজস্ব চিন্তাভাবনা, অন্য দিকে ছিল সত্যজিৎ রায়ের জীবনদর্শন সম্পর্কে তাঁহার গভীর মূল্যায়ন। তাহা এক উদার, সহিষ্ণু, আন্তর্জাতিকতার দর্শন। তাহার মূলে রহিয়াছে আপন সংস্কৃতির গভীর চর্চা ও অনুশীলনের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বসংস্কৃতির সহিত সংযোগ সাধন এবং সেই সংযোগ হইতে রসদ সংগ্রহ করিয়া আপন ভাবনা ও সৃষ্টিকে আবার বিশ্বের দরবারে পৌঁছাইয়া দেওয়া। ঘর ও বাহিরের এই নিরন্তর আদানপ্রদানের মাধ্যমে যে সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি, গত দুই শতাব্দীর বাঙালি তাহারই ধারক এবং বাহক। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়াই সে বৃহৎ বাঙালি হইয়া উঠিতে পারিয়াছিল। রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত তাহার শ্রেষ্ঠ প্রতিমূর্তি। সত্যজিৎ রায় সেই ধারার কৃতী অনুসারী। যেমন অমর্ত্য সেনও।
সত্যজিৎ রায় নিজে এই বিষয়ে সম্পূর্ণ সচেতন ছিলেন। সারা জীবন আপন সৃষ্টিতে, কথায় ও লেখায় তিনি নিজেকে প্রসারিত বিশ্বের নাগরিক হিসাবেই দেখিয়াছেন। ভারতীয় তথা বাঙালির জীবন-ঐতিহ্য ছানিয়া আপন চলচ্চিত্র গড়িয়া তুলিবার সঙ্গে সঙ্গে সেই সৃষ্টিকে বিশ্বের দরবারে হাজির করিবার সুযোগও এই কারণেই তাঁহার নিকট অত্যন্ত মূল্যবান ছিল। ১৯৮২ সালে এক নিবন্ধে তিনি লিখিয়াছিলেন, পথের পাঁচালী-র দীর্ঘ নির্মাণপর্বের মধ্যেই যখন অপ্রত্যাশিত ভাবে নিউ ইয়র্কের একটি ভবিষ্যৎ প্রদর্শনীতে তাহা দেখাইবার অগ্রিম প্রস্তাব আসে, তখন তাঁহার মন নাচিয়া উঠিয়াছিল। কারণ, তাঁহার অকপট উক্তি: “(ছবিটি নির্মাণের আর্থিক সংস্থানের তীব্র অভাব হেতু) ক্রমাগত বিপুল সঙ্কটে পড়িয়াও যে একটি কারণে আমি হাল ছাড়িয়া দিয়া সমগ্র প্রকল্পটি বন্ধ করিয়া দিই নাই, তাহা হইল এই আশা যে, এক দিন আমার ছবিটি পশ্চিম দুনিয়ার দর্শকদের নিকট পৌঁছাইবে।” ইহাকে নিছক পশ্চিমের বাহবা কুড়াইবার ক্ষুদ্র আগ্রহ মনে করিলে কেবল তাঁহার প্রতি বিরাট অন্যায় হইবে না, অন্যায় হইবে বৃহৎ বাঙালির ধারণাটির প্রতি। সেই বাঙালি আপন কৃতিকে বিশ্বের দরবারে পেশ করিয়া তবেই তাহার মূল্যায়ন করিতে চাহিয়াছে, কূপমণ্ডূকের আত্মপ্রশস্তি এবং পারস্পরিক পৃষ্ঠকণ্ডূয়নে তাহার মন ভরে নাই। সত্যজিৎ বৃহৎ বাঙালি ছিলেন।
আগামী কাল সত্যজিৎ রায়ের জন্মের শতবর্ষ পূর্ণ হইতে চলিয়াছে। বাঙালি তাঁহাকে নানা ভাবে স্মরণ করিবে। কোন বাঙালি? সে কি আপন চিন্তায় চেতনায় বৃহৎ? তাহার আত্ম-অন্বেষা কি বিশ্বমুখী? বাহিরের সহিত নিরন্তর আদানপ্রদানের মধ্য দিয়া সে কি আত্মসংস্কৃতির বিকাশ ঘটাইতে আগ্রহী? পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকাইয়া এই প্রশ্নের উত্তরে একটি গভীর দীর্ঘশ্বাস উঠিয়া আসে। বাঙালি এখন বিভিন্ন বিষয়ে তুচ্ছতার সাধক, বড় করিয়া কিছু ভাবিবার ক্ষমতাই সে যেন হারাইয়াছে। ব্যতিক্রম নিশ্চয় আছে, কিন্তু তাহা ব্যতিক্রম। সত্যজিৎ রায় আজ নাগরিক বাঙালির সমাজকে দেখিলে কী বলিবেন, তাহা লইয়া জল্পনার বিশেষ অবকাশ নাই। শেষ ছবি আগন্তুক-এ মনোমোহন মিত্রের কণ্ঠস্বরে তিনি তাঁহার কঠিন রায় শুনাইয়া দিয়া গিয়াছেন। তবে ইহাও সত্য যে, শেষ পর্যন্ত তিনি মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারান নাই। ছবির উপসংহারে মনোমোহন যখন তাঁহার বালক বন্ধু সাত্যকিকে জিজ্ঞাসা করেন, বড় হইয়া সে কী হইবে না, সেই কথা তাহার মনে আছে কি না, তখন তাহার বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দুইটি সটান ছোটদাদুর চোখে রাখিয়া সেই ভাবী নাগরিক উত্তর দেয়: কূপমণ্ডূক। বাঙালি চিরকাল কূপমণ্ডূকই থাকিবে, সত্যজিৎ তাহা ভাবিতেন না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy