এআই-এর ভিত্তিতে তৈরি ‘চ্যাটবট’ অর্থাৎ কথোপকথন চালানোর রোবটগুলি অচিরেই মানুষের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। ছবি: সংগৃহীত।
ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন থেকে চোখে আঙুল দাদা— নিজের উদ্ভাবনের ভয়াল পরিণতি দর্শনে বিব্রত বা বিপর্যস্ত হয়ে পড়া স্রষ্টাদের তালিকাটি দীর্ঘ। কেবল সাহিত্যে নয়, জীবনেও— পারমাণবিক বোমা থেকে শুরু করে পেপার স্প্রে পর্যন্ত নানা আবিষ্কারের মুখোমুখি হয়ে তাদের স্রষ্টা বা সৃষ্টিকর্মের অগ্রদূতেরা স্তম্ভিত বা মর্মাহত হয়েছেন, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে অনুশোচনা প্রকাশ করেছেন। জেফ্রি হিন্টন এই তালিকায় নবতম সংযোজন। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উদ্ভাবক হিসাবে বন্দিত এই আমেরিকান প্রযুক্তি-বিজ্ঞানী সম্প্রতি জানিয়েছেন এক গভীর আশঙ্কার কথা। তাঁর অনুমান, এআই-এর ভিত্তিতে তৈরি ‘চ্যাটবট’ অর্থাৎ কথোপকথন চালানোর রোবটগুলি অচিরেই মানুষের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। এমন বিপদ সৃষ্টির পিছনে নিজের ভূমিকার জন্য তিনি অনুতপ্ত। ইতিমধ্যে প্রযুক্তি-বিশ্বের অন্যতম প্রধান সংস্থার উচ্চপদও ছেড়ে দিয়েছেন ৭৫ বছর বয়সি হিন্টন। তাঁর মন্তব্য ও পদক্ষেপ নিয়ে এই মুহূর্তে দুনিয়া জুড়ে বিপুল শোরগোল উঠেছে।
শোরগোল অস্বাভাবিক নয়। এআই এবং চ্যাটবট নিয়ে সাম্প্রতিক কালে যে বিপদগুলির কথা সবচেয়ে বেশি শোনা গিয়েছে, হিন্টনও জোর দিয়েছেন সেগুলির উপরেই। প্রথম বিপদের নাম ভুয়ো তথ্য। অশুভ উদ্দেশ্যে মিথ্যাকে সত্য বলে চালানোর তৎপরতা গত কয়েক বছর ধরে অস্বাভাবিক মাত্রায় পৌঁছেছে, তার ফলাফলও অনেক সময়েই সমস্ত বিপদসীমা ছাড়িয়ে বিধ্বংসী আকার নিয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে সত্যপুচ্ছধারী মিথ্যার উৎপাদন এবং প্রসার কেবল সহজ নয়, অকল্পনীয় রকমের শক্তিশালী হতে পারে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-পরিসংখ্যান ‘চুরি’ করে এবং অর্থব্যবস্থা ও প্রতিরক্ষা পরিকাঠামোর প্রযুক্তি-শৃঙ্খলায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে বিপর্যয় সৃষ্টির আশঙ্কা। এই ধরনের সম্ভাব্য বিপদের দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে হিন্টন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। পুতিন এবং তাঁর রাষ্ট্রযন্ত্রের সম্ভাব্য ক্রিয়াকলাপ সত্যই আশঙ্কার কারণ, তবে দুনিয়ার অন্যত্র, হিন্টনের আপন দেশেও, ক্ষমতাবানের হাতে প্রযুক্তির অপব্যবহার কী মারাত্মক বিপদ সৃষ্টি করতে পারে, তার দৃষ্টান্তও এই গ্রহের অধিবাসীদের অজানা নয়।
সম্ভাব্য অন্য বিপদটি ঈষৎ ভিন্ন গোত্রের। তা হল কর্মচ্যুতির আশঙ্কা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে অনেক ধরনের কাজে যন্ত্রমানবকে মানুষের পরিবর্ত হিসাবে ব্যবহার করা হয়ে চলেছে। চ্যাটবট এই পরিবর্তনের মাত্রা এবং ব্যাপ্তি দুই-ই বাড়িয়ে তুলতে পারে। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন সংস্থায় তেমন উদ্যোগ শুরু হয়েছে— একটি অতিকায় প্রযুক্তি সংস্থার কর্ণধার জানিয়েছেন যে, সেখানে আগামী পাঁচ বছরে এআই ব্যবহার করে প্রায় আট হাজার কর্মীর কাজ করিয়ে নেওয়া যাবে। সমস্যাটি এক অর্থে প্রাচীন। মানুষের কাজ যদি যন্ত্র তথা প্রযুক্তি করে দিতে পারে, তা হলে কাজের সুযোগ কমে— বহু কাল ধরেই এই প্রক্রিয়া চলে আসছে। কিন্তু প্রযুক্তির ব্যবহার বন্ধ করা হয়নি, করার যুক্তিও নেই। কোনও একটি বা এক ধরনের কাজে মানব-কর্মীর প্রয়োজন কমলেও সামগ্রিক ভাবে অর্থনীতির প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে কর্মীর চাহিদা বেড়েছে, প্রযুক্তির কল্যাণে উৎপাদনশীলতা বেড়েছে, দেশের সমৃদ্ধি হয়েছে। তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে একটি বিশেষ অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে— এই প্রযুক্তি কী ভাবে এবং কত দ্রুত অগ্রসর হবে, তার ফলে কর্মীর চাহিদা ও ভূমিকা কোথায় কতটা বদলাবে, তা একেবারেই স্পষ্ট নয়। হিন্টন বলেছেন, এআই তার বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগে মানুষের মস্তিষ্ককে অতিক্রম করতে পারে। এই সম্ভাবনা আক্ষরিক অর্থেই অ-পূর্ব, এবং তার তাৎপর্য স্পষ্টতই সুদূরপ্রসারী। তাঁর আশঙ্কা কত দূর বাস্তবসম্মত, সে বিষয়ে তর্ক থাকতে পারে, কিন্তু আশঙ্কাটি উড়িয়ে দেওয়ার কোনও উপায় নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy