এই রাজ্যে রাজনীতিকদের কটূক্তি যেন, বিচ্যুতি নয়, স্বাভাবিক বলে সাব্যস্ত হয়েছে। প্রতীকী ছবি।
এক দিকে ‘দুর্নীতির মহাসমুদ্র’ ক্রমশ উত্তাল থেকে উত্তালতর হয়ে উঠছে; অন্য দিকে সরকারি কর্মীরা বকেয়া মহার্ঘ ভাতা মেটানোর দাবিতে লাগাতার বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছেন। মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চয়ই ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে অতিমাত্রায় বিব্রত এবং বিরক্ত বোধ করছেন। এমন বহুমুখী বিরোধিতা ও বিড়ম্বনা ঠান্ডা মাথায়, সংযত ভঙ্গিতে সামলানোর জন্য যে স্ব-ভাব এবং অনুশীলনের প্রয়োজন হয়, তাঁর আচরণে তা কস্মিনকালেও দেখা যায়নি। নিন্দা, সমালোচনা ও দাবিদাওয়ার মোকাবিলায় তিনি উত্তরোত্তর ক্রুদ্ধ মূর্তি ধারণ করবেন, সে-কথা অভিজ্ঞ নাগরিকদের অজানা নয়। এবং তাঁরা বিলক্ষণ জানেন যে, সেই মূর্তি স্বভাবত সুভাষিণী নয়, ক্রোধ এবং ক্ষোভ তার কণ্ঠে ভয়ানক রকমের তীব্র আকার ধারণ করে। সুতরাং মুখ্যমন্ত্রী মহার্ঘ ভাতার দাবিতে আন্দোলনরত কর্মীদের— তাঁরই সরকারের কর্মীদের— ‘চোর-ডাকাত’ সম্বোধন করেছেন জেনে অবাক হওয়ার মতো মানুষ পশ্চিমবঙ্গে আজ আর সহজে খুঁজে পাওয়া যাবে না, বরং নাগরিকরা নিতান্ত উদাসীন ভাবে বলবেন, “এই সব ভাষাই তো এখন চলছে।”
কথাটি মিথ্যা নয়। সুরুচির গর্বে সতত গর্বিত পশ্চিমবঙ্গের সমাজজীবনে কুভাষার উপদ্রব এক অভূতপূর্ব মাত্রায় পৌঁছেছে। এই পরিস্থিতির পিছনে রাজনীতির নায়কনায়িকাদের ভূমিকা বিরাট। অসংযত অশোভন বাগ্ধারা নতুন কিছু নয়। অতীতেও রাজনীতিকদের মুখে কটুভাষণ অশ্রুত ছিল না, বিশেষত বিরোধী পক্ষের নেতাদের ব্যক্তিগত আক্রমণের শোচনীয় নজির সৃষ্টি করার ব্যাপারে এ রাজ্যের বামপন্থীদের ঐতিহাসিক ভূমিকাটি লজ্জার এবং কলঙ্কের। আপন উৎকর্ষের মহিমায় সতত বিমুগ্ধ বামপন্থীরা মনে মনে বিলক্ষণ জানেন যে যুগে যুগে অতুল্য ঘোষ থেকে শুরু করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবধি অনেকেই তাঁদের শিবির থেকে অবিশ্বাস্য রকমের কদর্য কটূক্তি ও গালিগালাজের শিকার হয়েছেন। কিন্তু সেই ভাষা ও তা উচ্চারণের ভঙ্গিকে বরাবর সভ্যতার মানদণ্ড থেকে বিচ্যুতি বলেই গণ্য করা হয়েছে, সেই অপরাধে অপরাধী ব্যক্তি বা দল সমাজের কাছে তিরস্কৃত হয়েছে।
আজকের সঙ্কট এক ভিন্ন মাত্রার। নিরন্তর গালিগালাজে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা এই রাজ্যে রাজনীতিকদের কটূক্তি যেন, বিচ্যুতি নয়, স্বাভাবিক বলে সাব্যস্ত হয়েছে। গত কয়েক দিনের মধ্যেই তার নানা পরিচয় পেয়েছেন রাজ্যবাসী। শাসক দলের মুখপাত্র বিরোধী শিবিরের তরুণ নেতার ‘বিলাসব্যসন’ নিয়ে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছেন, সেই নেতা তার ‘সমুচিত জবাব’ দেওয়ার তাড়নায় ওই মুখপাত্রের পিতৃপরিচয় নিয়ে এমনই উৎকট মন্তব্য ছুড়ে দিয়েছেন, যা একই সঙ্গে চরম কুরুচি এবং চূড়ান্ত অশিক্ষার অভিজ্ঞান— অলীক কুনাট্যের পরের দৃশ্যে ভুল স্বীকার করে (বা দলীয় অভিভাবকদের তাড়নায় ভুল স্বীকার করতে বাধ্য হয়ে) সে কলঙ্ক মোছা যায় না। আবার, শিক্ষা-দুর্নীতি নিয়ে মহাসমুদ্র-প্রমাণ অভিযোগের জবাব দিতে অনুপ্রেরিত হয়ে শিক্ষামন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে বিরোধী দল ও তার নেতা-কর্মীদের সম্পর্কে এমন ভাষায় ও ভঙ্গিতে সদুক্তিকর্ণামৃত বর্ষণ করেছেন যা শুনলে মনে পড়ে সেই বহুচর্চিত পঙ্ক্তি: কে জানে গরল কিনা প্রকৃত পানীয়, অমৃতই বিষ। তথ্যের বদলে কটুকথা, বিতর্কের বদলে গালিগালাজ, যুক্তিপূর্ণ প্রত্যুত্তরের বদলে ব্যক্তিগত আক্রমণ— এই খেলায় মস্তিষ্কের কোনও পরিশ্রম নেই, চিন্তাশক্তির কোনও দায় নেই। রাজ্যের মুখ্য প্রশাসকও বুঝি সেই খেলাই খেলতে চান। এক দিকে তিনি এবং তাঁর সতীর্থরা ‘চিরকুট’ ‘চিরকুট’ বলে শোরগোল তুলে চলেছেন। তথ্যপ্রমাণের অভাবে সেই চিৎকার শূন্যকুম্ভের আওয়াজ মাত্র, যে আওয়াজ একই সঙ্গে করুণ এবং হাস্যকর। আবার, সেই সত্য মর্মে মর্মে জানেন বলেই হয়তো মুখ্যমন্ত্রী কখনও ‘কুকুর-বেড়াল’, কখনও ‘চোর-ডাকাত’ বলে বিরোধীদের গালি দিচ্ছেন। এ বড় দুর্ভাগ্যের কথা। দুর্ভাগ্য রাজ্যবাসীর, দুর্ভাগ্য তাঁর নিজেরও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy