—ফাইল চিত্র।
কাজলকৃষ্ণ কুঞ্চিত কেশদাম, দুই চোখে কখনও প্রশান্তি, কখনও রুদ্ররূপ, আর অভয়মুদ্রায় ঝরে পড়া আশীর্বাদ— এ সব ছাড়িয়ে বেলগাছিয়ার একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে সরস্বতী মূর্তি পূজিত হল, তার সঙ্গে চিরন্তন দেবীমূর্তির ফারাকটি সুস্পষ্ট এবং সুচিন্তিত। সে মূর্তি কেশহীন। ওই স্কুলেরই এক দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী কঠিন রোগে আক্রান্ত। ওষুধের প্রভাবে ঝরে গিয়েছিল তার মাথার চুল। তার লড়াইকে কুর্নিশ জানিয়ে, তার সমমর্মী হয়েই বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সরস্বতী মূর্তিকে কেশহীন রাখার। সে মূর্তির উদ্বোধনও হয়েছে ওই ছাত্রীর হাত দিয়ে। এই একত্বের বার্তাটি অনেকখানি পরিবর্তন ঘটিয়েছে মেয়েটির আত্মবিশ্বাসে। রোগকে অতিক্রম করার লড়াইয়ের নতুন রসদ খুঁজে পেয়েছে সে।
চিরাচরিত ভাবনায় এক সামান্য পরিবর্তনও কী অসামান্য ব্যঞ্জনার জন্ম দিতে পারে, আর এক বার তার প্রমাণ মিলল। বৃহদর্থে দেখলে, ধর্ম তো জীবন থেকে বিচ্যুত কোনও চর্চা বা চর্যা নয়, কাজেই ধর্মীয় রীতি পালনেও যে সেই জীবনের অভিজ্ঞতা, ওঠাপড়ার ছায়া পড়বে, সেটাই স্বাভাবিক। স্থবিরতাকে আঁকড়ে থাকলে বরং এক সময় তা ভারাক্রান্ত হবে, হবে গতিহীনও। এই সাধারণ বোধটির চর্চাই এই যুগে জরুরি। ধর্মকে যাঁরা মহা আড়ম্বরে, বৈভবে, কিংবা ঐতিহ্যের গুরুভারে আটকে রাখায় বিশ্বাসী, তাঁরা বোঝেন না যে বাস্তব জীবনের সঙ্গে ধর্মকে মিশিয়ে নিলে, তাকে ‘মানবধর্ম’-এর একাসনে ঠাঁই দিলে, তার আবেদন কত অনায়াসে মানবমনে প্রবেশ করতে পারে। স্বস্তি যে, সাম্প্রতিক কালের রাজনীতিকরা সেই বোধ হারালেও এ বঙ্গের সাধারণ নাগরিকরা সেই বোধটির চর্চা করে চলেছেন। দুর্গাপুজোর সাম্প্রতিক ‘থিম’-এও তার প্রমাণ। ঠিকই, ‘থিম’পুজো যেমন কখনও প্রবল ও বিষম হয়ে ওঠে, আবার কোনও কোনও দেবীকল্পনায় দৈনন্দিন জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। সেখানে মা দুর্গার অসুরদলনী মূর্তি ছাপিয়ে প্রতিষ্ঠা পায় লালপেড়ে সাদা শাড়িতে গৃহস্থ বধূর মূর্তি, পুত্র-কন্যা সমেত ভরা যিনি সংসার সামলাচ্ছেন দশ হাতে। বিশুদ্ধবাদীরা যতই নাক কোঁচকান, এই পরিবর্তন শুষ্ক, কঠিন ধর্মীয় আচারকে জীবনের আরও কাছে নিয়ে আসে, একান্ত আপন করে তোলে।
এই পরিবর্তনের ধারাটি কি বঙ্গেরই নিজস্ব? ধর্মীয় আচারের শাস্ত্রসর্বস্বতা, কঠোর নিয়মবিধি বঙ্গদেশে জলহাওয়াতেই কি কোমল হয়ে যায়? নতুন কথা নয়, বহু যুগ ধরেই এখানকার মাটিতে ধর্মের রীতি-নীতির দুর্লঙ্ঘ্যতা কমে গিয়ে তাতে ভরে থেকেছে দৈনন্দিনতার সহজ-সরল জীবন-নির্যাস। তাই অযোধ্যার রামচন্দ্র বীরচূড়ামণি হলেও বঙ্গের কবিকল্পনায় অনেক বেশি রকম নবদূর্বাদলশ্যাম, যিনি সীতার বিরহে কেঁদে আকুল। এই কারণেই হিন্দুত্ববাদের নবপ্রতাপে যখন বাকি দেশ জমকালো আরাধনার অনুসারী, সেই একই সময়ে ছকভাঙা ভাবনায় ভর করে পশ্চিমবঙ্গে দেখা যায় পুরোহিতের পরিবর্তে নারীরা পূজা করেন— কোথাও শিক্ষিকারা, কোথাও ছাত্রীরা নিজেরাই তা করেন। এরই মধ্যে শিক্ষিকারা অসুস্থ ছাত্রীর ভিতর সরস্বতীকে খুঁজে পেলে তাতে বাঙালির আশ্চর্য না হয়ে আশ্বস্ত বোধ করা উচিত। ধর্ম নিয়ে ক্ষমতাপ্রতাপের মাতামাতি এবং বিভেদরচনার নিত্যনতুন কারিগরির যুগেও যে বাঙালির পূজা ব্যতিক্রমী হতে পারছে, তা এক বিরাট ভরসার কথা বইকি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy