প্রতীকী ছবি।
কোভিডতরঙ্গও যাহাতে আঁচড় কাটিতে পারে নাই, তাহা হইল বর্তমান ভারতবর্ষ জুড়িয়া বহিতে থাকা প্রবল ঘৃণা আর বিদ্বেষের ঢেউ। লক্ষণীয়, তাহার মধ্যে খ্রিস্টানবিরোধিতার ধারাটিও ক্রমশ বলীয়ানতর। এমনকি যে সকল সংগঠন নামপরিচয়ে খ্রিস্টান, কিন্তু প্রত্যক্ষত ধর্মবিষয়ক কাজে লিপ্ত থাকিবার বদলে হাতেকলমে সমাজকল্যাণমূলক কাজে ব্যস্ত, তাহাদের বিরুদ্ধেও কোমর বাঁধিয়া যুদ্ধ ঘোষণা করা হইতেছে। অভিযোগ তোলা হইতেছে, উহারা মুখে এক, কাজে আর এক। ভুলাইয়া ধর্মান্তর করানোই নাকি উহাদের লক্ষ্য। বুঝিতে অসুবিধা নাই, একবিংশ শতকের ভারতে এই অসহিষ্ণুতার কারবার এক দিকে সহজিয়া জাতীয়তাবাদের টোটকার বিজ্ঞাপনে উদ্বেলিত, অন্য দিকে সংখ্যালঘুবিরোধিতার দাঁতালো বিষোদ্গারে শাণিত। খ্রিস্টানরা নাকি এই দেশে হিন্দুসমাজের ক্ষতিসাধন ব্যতীত অন্য কোনও কাজই করিতে পারে না, ইহাই হইল বিদ্বেষপ্রোথিত বিশ্বাস। পরিস্থিতি দেখিয়া দুইশত বৎসর আগের এক খ্রিস্টান মানুষের কথা মনে পড়িতে পারে: হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজ়িয়ো। অবশ্য অন্য এক কারণেও তিনি এখন স্মরণীয়। রাজা রামমোহন রায়ের অর্ধদ্বিশতবর্ষে ডিরোজ়িয়োর কথা বিস্মৃত হওয়া অন্যায়। আর, রামমোহনের সহিত ডিরোজ়িয়োর সম্পর্ক কী এবং কেন, এই প্রশ্ন যাঁহারা তোলেন— বিশেষ ভাবে তাঁহাদের জন্যই এই দ্বিতীয় ব্যক্তির উপর আলোকপাত জরুরি।
ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের জনক হিসাবে ডিরোজ়িয়োর নাম ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকের অন্তর্ভুক্ত। ইতিহাসের গভীরতর অনুসন্ধান অবশ্য দেখাইবে যে, এই আন্দোলনের খ্যাতি কিংবা কুখ্যাতি সর্বাংশে তাঁহার নামের সহিত যুক্ত হওয়া অনুচিত, কেননা বেশ কিছু ক্ষেত্রে তাঁহাদের মধ্যে গুরুতর দূরত্ব ছিল। ইয়ং বেঙ্গলের সদস্যদের অনেকেই ধর্মান্তরিত হইয়াছিলেন, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা মহেশচন্দ্র ঘোষ স্মরণীয়— তবে জন্মসূত্রে খ্রিস্টান কিন্তু আজীবন তীব্র নিরীশ্বরবাদী ডিরোজ়িয়োকে এই ধারার সহিত একাত্ম করিয়া দেখা অনুচিত। প্যারীচাঁদ মিত্রের বহু-উদ্ধৃত বাক্যটি আর এক বার উল্লেখ্য: মাত্র সতেরো বৎসর বয়স হইতে ইংরেজি সাহিত্য বিষয়ে শিক্ষকতায় যোগদানকারী হিন্দু কলেজের এই মাস্টারমহাশয় ১৮৩০-এর দশকে তাঁহার ছাত্রদের উপর যে কয়েকটি ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব বিস্তার করিয়াছিলেন, তাহা হইল, স্বাধীন চিন্তা, সুবিচার, সুবিবেচনা, পরোপকার— ‘টু লিভ অ্যান্ড ডাই ফর ট্রুথ’। ধর্মসমাজকে অসম্মান করিতে তিনি শিখান নাই, ধর্মসমাজ সত্ত্বেও ‘নিজের মতো’ করিয়া ভাবিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিলেন। তাঁহার বহু শিষ্যই পরবর্তী কালে অনেক দূর আগাইয়া হিন্দুধর্মকে অসম্মান করিবার খেলায় মাতিয়াছিলেন, দুর্ভাগ্য যে সেই খেলার সহিত স্বয়ং ডিরোজ়িয়োর নামও জড়াইয়াছে। গবেষণা বলিতেছে, ডিরোজ়িয়োর ‘নিজের মতো’ করিয়া ভাবা হইতে কোনও প্রতিষ্ঠানই তাঁহাকে নিরস্ত করিতে পারে নাই, হিন্দু সমাজও নহে, খ্রিস্টান সমাজও নহে। কোথাও অযুক্তি বা অবিবেচনাকে তিনি প্রশ্রয় দেন নাই। তাই ভলতেয়ার কিংবা হিউমের দর্শন অনুযায়ী যুক্তিনির্মাণ শিখাইতে যিনি ভালবাসিতেন, কলিকাতা-জাত কলিকাতা-প্রয়াত সেই মানুষটি তাঁহার অসংখ্য কবিতার মধ্যে লিখিয়া গিয়াছেন ‘টু মাই নেটিভ ল্যান্ড’ নামে কবিতাও। তাঁহার ‘নেটিভ ল্যান্ড’ ভারত তাঁহাকে আপন করিতেছে কি না, জানিবার জন্য তিনি অপেক্ষা করেন নাই, ‘নিজের মতো’ করিয়া দেশপ্রেম অনুভব ও প্রকাশ করিয়া গিয়াছেন।
জাতীয়তাবাদের অদ্যকার ধ্বজাধারীরা কি জানেন, যাঁহাদের জন্য পরাধীন দেশে ক্রমে জাতীয়তাবাদের বোধটি উদিত হইয়াছিল, ডিরোজ়িয়ো নামে খ্রিস্টান ভদ্রলোকটি তাহার জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ? মজার কথা, সে দিনকার হিন্দুসমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও এই কথা বুঝেন নাই, তাই তড়িঘড়ি তাঁহাকে হিন্দু কলেজের পদটি হইতে অপসারণের বন্দোবস্ত করিয়াছিলেন। তাঁহারা বুঝেন নাই যে ডিরোজ়িয়োর স্বাধীন চিন্তার শিক্ষাই তাঁহাদের ভারতীয় সমাজকে স্বাধীন প্রতিষ্ঠার
দিকে কয়েক পা ঠেলিয়া দিতেছে। ধর্মান্ধতা ও সংস্কারান্ধতার সমস্যাই এইখানে। কোন দিক হইতে কোন দরজাটি খুলিতে পারে, কোন আলোকে অন্ধকার দূর হইতে পারে, অন্ধতার প্রকোপে এ সব তাঁহারা দেখিতে পান না। সে দিনও পারিতেন না, আজও পারেন না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy