ছবি: সংগৃহীত।
সত্য প্রকাশের দায় সাংবাদিকের, কিন্তু তাহার অনুকূল পরিস্থিতি নিশ্চিত করিবার দায় সমগ্র বিশ্বের। রাশিয়া এবং ফিলিপিন্সের দুই সাংবাদিককে শান্তি পুরস্কার দিয়া নোবেল পুরস্কার কর্তৃপক্ষ যেন তাহাই মনে করাইলেন। দ্মিত্রি মুরাতভ এবং মারিয়া রেসা বহু বৎসর যাবৎ কারাদণ্ড এবং মৃত্যুর ঝুঁকি মাথায় করিয়া তথ্যনিষ্ঠ, নির্ভীক সাংবাদিকতার কর্তব্য পালন করিয়া আসিতেছেন। তাঁহাদের কৃতিত্ব অসামান্য, তাঁহাদের কাজ দৃষ্টান্তমূলক— তাঁহারা দুই জন এই সম্মানের যোগ্য, সন্দেহ নাই। তবু তাঁহাদের পুরস্কার উদ্যাপনের কালে মনে রাখিতে হইবে তাঁহাদের মতোই দৃঢ়সঙ্কল্প সেই সকল সাংবাদিককে, যাঁহারা সত্যকথনের কর্তব্য পালন করিতে গিয়া প্রাণ হারাইয়াছেন। ভারতেও এমন সত্য-শহিদের সংখ্যা কম নহে। ভারত তথা বিশ্বের বহু শত সাংবাদিক আজ তথ্য প্রকাশের ‘অপরাধ’-এ কারাগারের অন্তরালে দিন কাটাইতেছেন, পুলিশ অথবা সামরিক বাহিনীর নির্যাতন সহিতেছেন, দেশান্তরি হইয়াছেন, মিথ্যা মামলা লড়িতে সর্বস্বান্ত হইয়াছেন। তাঁহাদের দেখিয়া সাংবাদিকদের একটি বৃহৎ অংশ রাষ্ট্র-প্রচারিত মিথ্যাকে নস্যাৎ করিয়া প্রকৃত তথ্য প্রকাশের ঝুঁকি লইতে দ্বিধা করিতেছেন। নিরাপদে থাকিতে তাঁহারা নীরবতাকে আশ্রয় করিয়াছেন। অন্য দিকে, ‘সাংবাদিক’ তকমাধারী কিছু ব্যক্তি নিয়ত ক্ষমতাসীনের মহিমাকীর্তন করিয়া, গণমাধ্যমে ভ্রান্তি ছড়াইয়া, সত্যবাদীদের অসম্মান করিয়া, তুচ্ছ বিষয়কে বৃহৎ এবং বৃহৎকে ক্ষুদ্র দেখাইয়া আপন স্বার্থ চরিতার্থ করিতেছেন। যাঁহারা নীরবতা এবং স্তাবকতা, উভয়কেই প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন, সেই সাংবাদিকদের মধ্যে মারিয়া রেসা এবং দ্মিত্রি মুরাতভ অগ্রগণ্য।
ক্ষমতাবানের সম্মুখে দাঁড়াইয়া নির্ভীক সত্যকথন— ইহাই সাংবাদিকতার প্রথম শর্ত। অথচ তাহা আজ যেন এক বিরল, ব্যতিক্রমী কীর্তি হইয়া উঠিয়াছে। সাংবাদিকের নোবেলপ্রাপ্তি উদ্যাপনের ক্ষণটি তাই বিশ্বের সাংবাদিক সমাজের নিকট যুগপৎ আনন্দ ও বিষাদের মুহূর্ত। সাংবাদিকের স্বাধীনতার প্রতি দেশনায়কেরা কত নিষ্করুণ, তাহার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণই যেন এই পুরস্কারের প্রকৃত তাৎপর্য। তথ্য প্রকাশকে ‘অপরাধ’ এবং প্রকাশককে ‘দেশদ্রোহী’ সাব্যস্ত করিবার প্রশাসনিক কৌশলটি পুরাতন। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে মিথ্যা রটনা, বিভ্রান্তি নির্মাণ এতই সহজ এবং দ্রুত হইতে পারে যে, জনমানসের উপর শাসকগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ আজ অভূতপূর্ব পর্যায়ে পৌঁছাইয়াছে। বিশেষত সমাজমাধ্যম শাসকদের হাতে এক অমোঘ ‘অস্ত্র’ হইয়া উঠিয়াছে, যাহা ব্যবহার করিয়া ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা সাংবাদিকদের নিয়ত আক্রমণ করিতেছেন। বহু সহস্র বার মিথ্যা বলিলে তাহা বিশ্বাসযোগ্য হইয়া উঠে, তাহা প্রমাণ করিতে সদানিযুক্ত রাজনৈতিক প্রশ্রয়প্রাপ্ত ‘ট্রোলবাহিনী’। তাহার পর রহিয়াছে রাষ্ট্রক্ষমতার অপপ্রয়োগ। মারিয়া রেসা দাবি করিয়াছেন, কেবল জামিন পাইতে যত অর্থ তিনি ব্যয় করিয়াছেন, তাহা দুর্নীতি-অভিযুক্ত ইমেল্ডা মার্কোসের অর্থদণ্ডের তুলনায় অধিক। দ্মিত্রি তাঁহার সংবাদপত্রের ছয় সাংবাদিক-সহকর্মীর নিধন দেখিয়াছেন। তাঁহাদের নোবেল-প্রাপ্তি এই ভয়ঙ্কর বাস্তবের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করিতেছে। সত্যকে পথ করিয়া না দিলে, বাক্স্বাধীনতাকে সম্মান না করিলে যে মানবকল্যাণের পথ রুদ্ধ হইবে, এই পুরস্কার সে বিষয়ে বিশ্বকে সতর্ক করিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy