আজ স্বাধীনতা দিবস। আজ স্কুল ছুটি। নয়ডার যে বেসরকারি স্কুলটি সম্প্রতি খবরের শিরোনামে উঠে এল, তার কর্তৃপক্ষ চাইলে এই ছুটির অবকাশে ভাবতে পারেন, গত ৭ অগস্ট স্কুলের অভিভাবকদের পাঠানো যে ঘোষণার জেরে তাঁরা প্রবল সমালোচিত হলেন, তার সঙ্গে ‘স্বাধীনতা’র যোগটি কোথায় এবং কতটা। সমাজমাধ্যম-গ্রুপে তাঁরা অভিভাবকদের জানিয়েছিলেন, বাচ্চাদের টিফিনবাক্সে যেন কোনও আমিষ খাবার ভরে পাঠানো না হয়। কেন? এক: সাতসকালে তৈরি খাবার স্কুলের দীর্ঘ সময়ে, বিশেষত নয়ডার গরমে নষ্ট হয়ে যেতে পারে, এবং দুই: স্কুলে যাতে সব অবস্থায় সকলকে নিয়ে, সকলের জীবন-অভ্যাসকে গুরুত্ব দিয়ে চলার পরিবেশ অটুট অক্ষুণ্ণ থাকে, সে নিয়ে কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত সচেতন। এই ঘোষণায় শোরগোল ওঠা অস্বাভাবিক নয়, বহু অভিভাবক প্রতিবাদ করে বলেছেন, স্কুল এ ভাবে ছেলেমেয়েদের খাবারের অভ্যাস ও পছন্দ ঠিক করে দিতে পারে না। আবার বহু অভিভাবক সমর্থনও করেছেন— তাঁদের শিশুরা নিরামিষ খাবারেই অভ্যস্ত। প্রবল হইচইয়ের জেরে কর্তৃপক্ষ এখন ঢোঁক গিলে বলেছেন, এ তাঁদের ঘোষণা নয়, অনুরোধ মাত্র।
একটি স্কুল, পড়াশোনারও বাইরে যার হয়ে ওঠার কথা জীবনের শিক্ষা, মানবতা ও মানবিকতার পাঠ দানের মুক্ত পরিসর, সে-ও যখন পড়ুয়াদের টিফিনে আমিষ-নিরামিষ নিয়ে জবরদস্তি সিদ্ধান্ত চাপাতে চায়, তখন তা অতি দুর্ভাগ্যের। এই ইস্কুলে নিশ্চয়ই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস পড়ানো হয়, আজ পনেরোই অগস্টে সাড়ম্বরে জাতীয় পতাকা উত্তোলনও হয়তো হবে, কিন্তু এই সব প্রাতিষ্ঠানিকতা আনুষ্ঠানিকতা পেরিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ স্বাধীন সার্বভৌম ভারতের মূল সুরটি ছেলেমেয়েদের শেখাতে পারলেন কি? বোঝাতে পারলেন কি, এই দেশকে স্বাধীন করেছেন যে সংগ্রামী বিপ্লবী নেতা ও মানুষ, তাঁরা চলনে-বলনে, আচার-অভ্যাসে, ভাষায় ভূষায় ছিলেন পরস্পরের থেকে একেবারে আলাদা? স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ে সেই পৃথকত্ব কোনও সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়নি, কারণ তাঁরা স্থিরলক্ষ্য ও একাত্ম ছিলেন সবচেয়ে বড় ব্রতে— দেশকে পরাধীনতা থেকে মুক্ত করতে। ভাষা সংস্কৃতি পোশাক খাবার-সহ জীবনচর্যার— এবং মতাদর্শেরও— এই পৃথকত্বই যে ভারতের বিশিষ্টতা, তার সম্পদ, সে কথা কি বারংবার বলা উচিত নয়, বিশেষত ছাত্রছাত্রীদের?
এই বহুত্ববাদ অর্জন করা গিয়েছে অনেক লড়াই, রক্তক্ষয় ও ত্যাগের মূল্যে। এখনকার ভারতশাসকেরা সেই বহুত্ববাদের কথা বলেন না, তা আচরণও করেন না, ‘বৈচিত্রের মধ্যে একতা’ থেকে তাঁরা বৈচিত্রকে ছুড়ে ফেলতে চাইছেন, প্রতিষ্ঠা চাইছেন এক সমসত্ত্ব, উগ্র ‘এক’-এর। রাজনীতির ক্ষেত্রে সেই কার্যসিদ্ধির হাতিয়ার ধর্ম, আর সমাজ ও জনজীবনে অস্ত্র করা হচ্ছে কখনও হিন্দি ভাষাকে, কখনও নিরামিষ খাদ্যাভ্যাসকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষত স্কুলগুলি যদি এই অভিসন্ধি বুঝতে না পারে, তদুপরি জানতে বা অজানতে তারই দোসর হয়ে পড়ে, তার চেয়ে ক্ষতিকর আর কিছুই নয়। এই ভারতে স্কুলে স্কুলে ইতিহাস-বইয়ের পাঠ পাল্টে যাচ্ছে, এখন টিফিনবাক্সে ঢুকছে আমিষ-নিরামিষ দ্বৈরথ। ‘বহু’র মধ্য থেকে ব্যক্তির ‘এক’কে বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা রক্ষা করতে বহুর অস্তিত্ব নিশ্চিত করতেই হবে— যে কোনও অবস্থায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy