রবীন্দ্র সরোবর যে শুধুমাত্র সৌন্দর্যায়নের বা বাণিজ্যিক স্বার্থে ব্যবহারের জায়গা নয়, সেখানকার বাস্তুতন্ত্রটিকে বাঁচিয়ে রাখাও যে অত্যন্ত জরুরি, তা বোধ হয় কলকাতা পুরসভার বোঝার সময় এসেছে। কলকাতাকে সুস্থ, সুন্দর রাখার দায়িত্বটি তারই, অথচ শহরের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র রবীন্দ্র সরোবরকে ঘিরে এ-যাবৎ তার কার্যকলাপগুলি যথার্থ ‘রক্ষক’-এর নয়। বরং সরোবরকে রক্ষার প্রশ্নে পরিবেশপ্রেমীরা যখন সরব হয়েছেন, তখন পুরসভার হাবভাবে উদাসীনতা এবং অ-সচেতনতাই স্পষ্ট হয়েছে। সম্প্রতি সরোবরের ভিতরে এক বিশাল জায়গা জুড়ে মাটি কাটার অভিযোগ উঠেছে সরকারি সংস্থা কেএমডিএ-র বিরুদ্ধে। পরিবেশকর্মীদের আশঙ্কা, যেখানে মাটি কাটা হচ্ছে, সেখানে প্রচুর সাপ, নানা কীটপতঙ্গের বাস। এ ক্ষেত্রে যে পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে, তাতে ওই সরীসৃপ, কীটপতঙ্গগুলি চিরকালের মতো স্থানটি থেকে মুছে যেতে পারে। হঠাৎ মাটিতে কোপ কেন? জানা গিয়েছে, খেলার মাঠ তৈরির জন্য কেএমডিএ একটি বিশেষ সংস্থাকে ওই নির্দিষ্ট জায়গাটি দিয়েছে। সেই কারণে বেশ কিছু দিন যাবৎ মাটি কাটা চলছে। পরিবেশবিদদের আপত্তি সত্ত্বেও তা যে আগামী দিনে সহজে বন্ধ হবে না, অনুমান করাই যায়।
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং কংক্রিটায়নের চাপে ইতিমধ্যেই কলকাতার বৃহদংশ থেকে সবুজ অন্তর্হিতপ্রায়, অথচ বায়ুদূণের মাত্রা উদ্বেগজনক। এ-হেন পরিস্থিতিতে দক্ষিণ কলকাতার এই সুবিশাল জলাশয়টি নাগরিক স্বস্তিবিশেষ। জলাশয়, পাড়ের গাছপালা, দীর্ঘ হাঁটার রাস্তা, শরীরচর্চার ব্যবস্থা, শিশুদের পার্ক— সব মিলিয়ে প্রায় ১৯২ একর বিস্তীর্ণ এই অঞ্চল শুধুমাত্র সংলগ্ন অঞ্চলের নাগরিকদের পছন্দের জায়গাই নয়, বহু পাখি, কীটপতঙ্গের আশ্রয়স্থলও বটে। সুতরাং, সরোবরকে রক্ষা করাই এক যথার্থ পরিবেশপ্রেমী পুরপ্রশাসনের কর্তব্য হওয়া উচিত ছিল। কলকাতার দুর্ভাগ্য, তেমনটা দেখা যায়নি। বরং সৌন্দর্যায়নের ঠেলায় বার বারই এই স্থানের নাভিশ্বাস উঠেছে। অতীতে অভিযোগ উঠেছিল, জলাশয়ের মধ্যে লাগানো বড় ও চড়া আলোয় পাখি ও কীটপতঙ্গদের স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপ ব্যাহত হওয়ার। ছটপুজোকে ঘিরে পরিবেশকর্মী এবং রাজ্য সরকারের টানাপড়েনের ইতিবৃত্তও এত দ্রুত ভুলে যাওয়ার নয়। পুজোর কারণে সরোবরের জলদূষণ এবং নাগাড়ে বাজি ফাটানোয় সংলগ্ন পরিবেশের ক্ষতি হওয়ার প্রসঙ্গ তুলে শেষ পর্যন্ত জাতীয় আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল। সেই স্বস্তি থিতু না হতেই এ বার যন্ত্রের উপদ্রব শুরু।
প্রশ্ন হল, খেলার মাঠ তৈরির এই কেরামতি কি শহরের অন্যত্র দেখানো যেত না? কেন জঙ্গলে মোড়া অংশটি উজাড় করার চেষ্টা, যেখানে সমগ্র শহরেই গাছের সংখ্যা উদ্বেগজনক ভাবে কম। গত বছর গ্রীষ্মে রবীন্দ্র সরোবরের জলের স্তর বিপজ্জনক ভাবে কমে গিয়েছিল। আঙুল উঠেছিল চার পাশে গড়ে ওঠা বহুতলের দিকে। সেই অভিযোগ সত্যি কি না, জলস্তর নামতে থাকলে কী ব্যবস্থা করা উচিত, সে নিয়ে ভাবনাচিন্তা কত দূর এগিয়েছে? জলাশয় রক্ষার কোনও প্রকার উদ্যোগ না করে কেন এই অপ্রয়োজনীয় কর্মকাণ্ডে নজর? বার বার আদালত নির্দেশ দেবে, তবে রবীন্দ্র সরোবর রক্ষা পাবে, এমনটা চলতে দেওয়া যায় না। রবীন্দ্র সরোবরকে বাঁচিয়ে রাখার দায় সকলের— প্রশাসনের, নাগরিকেরও। সেই বোধোদয় এখনও না হলে কলকাতার সর্বনাশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy