—প্রতীকী চিত্র।
উনিশ শতকে বাঁধা গানে লালন শাহ ভারতে জাতপাতের যে ‘আজব কারখানা’-র কথা বলেছিলেন, এই একুশ শতকেও তা বন্ধ তো হয়নিই, তাকে পুরোদমে চালু রাখতে শাসকেরা অবতারণা করছেন নিত্যনতুন তত্ত্ব ও প্রয়োগের। প্রয়োগগুলি সামাজিক ভাবেই দৃশ্যমান: বিজেপি ও তার জোট-শাসিত রাজ্যগুলি থেকে অহরহ খবরে উঠে আসে জাতপাতের বিভেদ-বিদ্বেষ; ‘নিচু’ ও ভিন্ন জাতের মানুষকে শোষণ ও অত্যাচার, মেয়েদের ধর্ষণ, সম্মান রক্ষার্থে খুন। বিজেপির এই অবস্থান মতাদর্শগত। তাদের পথপ্রদর্শক আরএসএস-এর আদর্শগত প্রাণপুরুষ বিনায়ক দামোদর সাভারকর এই সংগঠনের জন্মের আগেই জানিয়ে রেখেছিলেন যে, হিন্দুরাষ্ট্রের অন্যতম ভিত্তি এই জাতব্যবস্থা— এ ছাড়া আর্যাবর্তের কল্পনাই হয় না। পরবর্তী কালেও যে সঙ্ঘের মত পাল্টায়নি, ‘গুরুজি’ গোলওয়ালকরের বাঞ্চ অব থটস তার সাক্ষ্য দেবে। তা সত্ত্বেও আরএসএস-এর সাম্প্রতিক মুখপত্রে যখন বুক বাজিয়ে লেখা হয় সমগ্র ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করেছে জাতপাতই, তখন বিস্ময়ের সীমা থাকে না— এ কেমন অন্ধকার, এক শতাব্দীব্যাপী ভারত রাষ্ট্রের অনন্যসাধারণ যাত্রাও যাকে মোচন করতে পারে না! ভাষা-সংস্কৃতির বিভিন্নতাকে অতিক্রম করা জাতীয়তার বোধ নয়, দেশের সংবিধানও নয়— শেষে কিনা জাতপাতকে ভাবতে হবে ভারতের সংযোগসেতু!
সাম্প্রতিক অতীতে আরএসএস-প্রধান মোহন ভাগবত বেশ কয়েক বার মুখ খুলেছিলেন জাতপাতের বৈষম্যের বিরুদ্ধে। গত বছর এমনও বলেছিলেন, জাতপাতের শিকার যে মানুষেরা গত দু’হাজার বছর ধরে ভুগছেন, তাঁদের জন্যই আরও দু’শো বছর হলেও সংরক্ষণ ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের পর, এই মুহূর্তে যখন বিরোধী দলগুলি জাতিগণনার দাবি ও জনসংখ্যার অনুপাতে সংরক্ষণের দাবি নিয়ে অত্যন্ত সরব, তখন বিজেপি-আরএসএস’কে এই বার্তা দিতে হচ্ছে যে তারা সংরক্ষণের বিরোধী নয়। কিন্তু এ যে স্রেফ মুখের কথা তা বুঝতে অসুবিধা হয় না, আসল সত্য উত্তরপ্রদেশ মধ্যপ্রদেশ উত্তরাখণ্ড রাজস্থানের মতো বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে জাতপাতের বিভেদ-বিদ্বেষের ছবি। এই বিভাজনের বিষ যে কেবল রাজ্য-রাজনীতির অন্দরে তা-ই বা বলা চলে কী করে— খাস লোকসভায় সাংসদ অনুরাগ ঠাকুর যখন বিরোধী দলের প্রধান নেতা রাহুল গান্ধীর ‘জাত’ নিয়ে প্রশ্ন ছোড়েন, সেই আচরণও প্রমাণ করে দেয় শাসক দলের আপাদমস্তক দ্বিচারিতা: তারা তত্ত্বকথায় জাতপাতকে করে তুলবে ভারতের সেতুবন্ধ, কাজের বেলায় জাতপাতকে অস্ত্র করে নিজেদের ক্ষমতা দেখাবে, ভোট দখল করবে।
গোলওয়ালকরের ভাবনায় হিন্দুত্ব ও জাতপাতের মধ্যে এক নিবিড় সম্পর্ক, মনু থেকে শুরু করে গীতার জীবিকাভিত্তিক বর্ণ-তত্ত্বে তাঁর বিশ্বাস, এবং জাতপাতের বিভাজনের দায় তিনি চাপান প্রথমত ‘বহিরাগত শত্রু’ ও পরে ব্রিটিশের ঘাড়ে। স্বাধীনতার সাতাত্তর বছর পেরিয়ে এসে, বহিঃশত্রু ও ব্রিটিশহীন দেশেও তা হলে কেন কুয়ো থেকে জল তোলায় নিচু জাতের লোকের বেঘোরে প্রাণ যেতে বসে, সে উত্তর আজকের বিজেপি-আরএসএস’এর কাছে নেই। তারা এটুকু জানে, রাজনীতির লাভের গুড়টি খেতে এই বিভাজন তাদের জিইয়ে রাখতেই হবে। সেটিই আসল রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা ও প্রকল্প, জাতপাতের সমর্থনে তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা তো নস্যি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy