ফাইল চিত্র।
বাণিজ্য সম্মেলনের শেষে হাতে রইল প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব, এবং বেশ কয়েকটি প্রশ্ন। প্রথমে মনে করিয়ে দেওয়া ভাল, যে কোনও বাণিজ্য সম্মেলনেই যত অঙ্কের মউ স্বাক্ষরিত হয়, প্রকৃত লগ্নির পরিমাণ তার সমান হয় না। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ভাইব্র্যান্ট গুজরাত সম্মেলনটিই। গুজরাতে লগ্নির পরিমাণ বাংলার তুলনায় বেশি, সে রাজ্যের সম্মেলনের আন্তর্জাতিক গুরুত্বও বেশি— কিন্তু, প্রস্তাবিত বনাম প্রকৃত লগ্নির অনুপাতটি কতখানি উন্নত, সেই অঙ্ক কষে দেখলে বিস্ময়ের অবকাশ থাকতে পারে। অতএব, বাংলার বাণিজ্য সম্মেলনে শুধু লগ্নির প্রস্তাবই আসে, রাজ্যে প্রকৃত লগ্নি আসে না, এমন অভিযোগ করলে তা অর্ধসত্য হবে। কথাটি বাংলার জন্য সত্য, কিন্তু অন্য রাজ্যগুলির জন্যও সত্য। দ্বিতীয় কথা হল, এই রাজ্যের শিল্প-সম্ভাবনা যথেষ্ট। স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে প্রায় চার হাজার কোটি টাকার লগ্নির প্রস্তাব আসার সংবাদটির তাৎপর্য পৃথক আলোচনা দাবি করে। শিক্ষা বা পর্যটনের মতো ক্ষেত্রেও পশ্চিমবঙ্গের সম্ভাবনা বিপুল, এই সংবাদপত্রের পাতাতেই কিছু দিন আগে কথাটি মনে করিয়ে দিয়েছিলেন বিশ্ব ব্যাঙ্কের ভূতপূর্ব মুখ্য অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু (‘শিক্ষাই উন্নয়নের পথ’, আনন্দবাজার পত্রিকা ১০০, ১৮-৩)। তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প বা অর্থনৈতিক হাব গড়ে তোলার যে চেষ্টা রাজ্যে হচ্ছে, তা-ও ফলপ্রসূ না হওয়ার কোনও কারণ নেই। এই রাজ্যে সুশিক্ষিত শ্রমশক্তি আছে; পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব ভারত, এবং প্রতিবেশী একাধিক দেশের কাছে পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক গুরুত্ব যথেষ্ট। রাজ্যের বাহ্যিক পরিকাঠামোরও উন্নতি হয়েছে। ফলে শিল্প, বাণিজ্য বা পরিষেবা, প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই রাজ্যের সম্ভাবনা যথেষ্ট।
কিন্তু, তার পরও প্রশ্ন থেকে যায়। প্রথম প্রশ্ন, সত্যিই কি শিল্প প্রস্তাবগুলির অন্তত একটা তাৎপর্যপূর্ণ অংশের বাস্তবায়ন ঘটছে? বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছেন, গত পাঁচ বছরে যতগুলি শিল্প প্রস্তাব এসেছে, এযাবৎ কালে তার কতগুলির উদ্বোধন হল। এই প্রশ্নের সদুত্তর মেলেনি। শিল্প সংক্রান্ত জমির জট কেটেছে, তেমন দাবি করলেও অনৃতভাষণ হবে। ডেউচা-পাঁচামিতে জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়াটি শেষ পর্যন্ত কোন পথে যায়, কোনও বড় অশান্তি ছাড়াই জমি অধিগ্রহণ করা সম্ভব হয় কি না— সেটাই বলে দেবে যে, রাজ্যে জমি পাওয়ার ব্যাপারে শিল্পপতিরা কতখানি নিশ্চিন্ত হতে পারেন। সিঙ্গুরের আত্মঘাতী রাজনীতির অভিশাপ থেকে রাজ্যের মুক্তি ঘটল কি না, এই মুহূর্তে তা বড় প্রশ্ন। দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, রাজ্যে শিল্প সংক্রান্ত জটিলতা কাটাতে প্রতি বারই কি মুখ্যমন্ত্রীর দ্বারস্থ হতে হবে? কিছু কমিটি তৈরি হয়েছে বটে, কিন্তু সেগুলির কার্যকারিতা আজ অবধি প্রমাণিত নয়।
শিল্প সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন যে, লগ্নিকারীরা যদি (রাজনৈতিক) সুস্থিরতা চান, যদি নিরাপত্তা ও স্বচ্ছতা চান, বাংলা তা দিতে পারে। বক্তব্যটির প্রথম ভাগে খানিক সত্যতা আছে, সে কথা ঠিক। নির্বাচনী সন্ত্রাসের কথা মাথায় রেখেও বলা যায় যে, রাজ্যে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের আধিপত্য অনস্বীকার্য। কিন্তু নিরাপত্তা? রাজ্যের প্রতিটি প্রান্তে যে কাণ্ড ঘটে চলেছে, সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য যতখানি প্রবল হয়ে উঠেছে, তা শিল্পের পক্ষে ভয়ঙ্কর। কোনও লগ্নিকারী সেধে এই বিপাকে পড়তে চাইবেন কেন? স্বচ্ছতার প্রশ্নটিও রাজ্যের পক্ষে ইতিবাচক নয়। মুখ্যমন্ত্রী বারে বারেই দলীয় এবং প্রশাসনিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। কিন্তু তাতে খুব কাজের কাজ হয়েছে, তেমন দাবি করা মুশকিল। বরং দলকেন্দ্রিক দুর্নীতি এই রাজ্যে প্রধান অর্থনৈতিক ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। এই সমস্যাগুলির সমাধান না করতে পারলে কি সম্মেলনের সাফল্যের প্রতিফলন রাজ্যের বাস্তবে ঘটবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy