অহিংসার মতো, অচৌর্য বা ‘অস্তেয়’-ও অভ্যাস করতেন মহাত্মা গান্ধী। তাঁর মতে, চুরি কেবল অন্যের দ্রব্য নিয়ে নেওয়াই নয়, অন্যের স্বত্ব অস্বীকার করাও চুরি করা। এমনকি মিথ্যে বলাও এক অর্থে চুরি করা, কারণ তাতে সত্যে অন্যের অধিকারকে হরণ করা হয়। যুক্তি দিয়ে চুরির এই বৃহৎ অর্থকে বুঝতে কষ্ট হয় না। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে তাকে কাজে লাগানোর কাজটি বড়ই কঠিন। এই মুহূর্তে তার দৃষ্টান্ত আফ্রিকার দেশগুলি। তাদের পেটে খিদে, সামনে গম-ভরা জাহাজ। কিন্তু আমেরিকা সকলকে সতর্ক করেছে, ও হল চোরাই মাল। ইউক্রেন থেকে প্রায় পাঁচ লক্ষ টন গম লুট করে রাশিয়া সুলভে বিক্রি করতে চায় বিশ্বের বাজারে। গান্ধীর নৈতিকতার সংজ্ঞা অনুসরণ করলে বলতে হয়, আফ্রিকার দেশগুলি যদি সেই গম নেয়, তা অন্যের স্বত্বহরণেরই সমতুল— রাশিয়া ইউক্রেনের থেকে যা লুট করেছে, আফ্রিকা তার ভাগ নিলে সেই লুটের অন্যায়ের ভাগীদারও হতেই হবে। কিন্তু, অন্নচিন্তা চমৎকারা। একেই আফ্রিকার বেশ কিছু অঞ্চলসতত দুর্ভিক্ষপ্রবণ, তার উপরে অতিমারি আর যুদ্ধের প্রকোপে গম অগ্নিমূল্য। আফ্রিকার দেশগুলি থেকে দাবি উঠেছে, রাশিয়ার গম ফিরিয়ে দিয়ে আফ্রিকার মানুষ কি না খেয়ে মরবে? উচিত কাজ করতে হলে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামাক ইউরোপ-আমেরিকা। এই উত্তর প্রত্যাশিত। কিন্তু নৈতিক প্রশ্ন জুতোর মধ্যেপেরেকের মতো, যখন বাইরে থেকে বিদ্ধ করার কেউ নেই, তখনও ভিতর থেকে রক্তাক্ত করতে থাকে। সুলভ পণ্য লোভনীয় বটে। কিন্তু অপরকে প্রতারিত, সর্বস্বান্ত করে বাজারে যা এসেছে, তা কিনলে আমিও কি পরোক্ষে সেই দস্যুবৃত্তির, উৎপীড়নের শরিক হয়ে পড়ব না?
লুটের ধন কেনার সপক্ষে একটা নৈতিক যুক্তি তৈরি রয়েছে— প্রাণরক্ষা। যে খিদেয় মরতে বসেছে, সে কেন বিচার করতে যাবে যে, দাতা কেমন লোক, বা তিনি কী উপায়ে ধন সংগ্রহ করেছেন? মহাভারতের মহাযুদ্ধের উদ্যোগপর্বে দুর্যোধন নিমন্ত্রণ করলে শ্রীকৃষ্ণ তা প্রত্যাখ্যান করে বলছেন, সম্প্রীতি থাকলে অথবা বিপদে পড়লে পরের অন্ন খাওয়া যায়। হয়তো ইঙ্গিত এই যে, ক্ষুধাকাতর মানুষের ন্যায়-অন্যায় বিচারের অবকাশ নেই, নৈতিক অনুজ্ঞা সেখানে চলে না। অথচ, মহাভারতেই মেলে এর বিপরীত কথা। তৃষ্ণার্ত ব্যক্তিও অপরের স্বত্বকে অগ্রাহ্যকরে জল খেতে পারে না। ‘এই জল আমার অধিকারে’— অন্তরিক্ষ থেকে এই বাণী অগ্রাহ্য করে সরোবর থেকে জল খাওয়ার জন্য প্রাণ হারালেন চার পাণ্ডব ভাই, তাঁদের এই চরম শাস্তি দিলেন স্বয়ং ধর্ম। একমাত্র যুধিষ্ঠির বলেছিলেন, অন্যের অধিকৃত বস্তু তিনি নিতে চান না, তাঁর আজ্ঞানুসারে প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তবে জল পান করবেন। এই কাহিনি হয়তো এমনই ইঙ্গিত দেয় যে, প্রশাসকের জন্য ধর্মের অনুশাসন আরও কঠোর, আরও অনমনীয়। যিনি সকলের স্বত্বের নিয়ামক, তাঁকে অন্যের স্বত্বাধিকার সব অবস্থায় মানতে হবে।
আরও একটি ইঙ্গিত মেলে এই গল্পে, তথা মহাভারতের নানা কাহিনিতে। তা হল, ন্যায়-অন্যায়ের বিচারের যথার্থ স্থানকাল রাজসভা, তর্কসভার অলস দ্বিপ্রহর নয়— সে বিচার করতে হয় জীবনের চরম বিপর্যয়ের মুহূর্তে, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। আজ আফ্রিকার সঙ্কটের সমাধানসূত্র নির্দেশ করতে মহাভারতকার হয়তো অনাহার-পীড়িত রাজ্যের রাজা ও শস্য লুণ্ঠনকারী বণিকের কথোপকথন দিয়ে আরও এক কাহিনি বুনতেন। আজকের প্রশাসকের কাছে তা বৃথা কালক্ষেপ। তাঁরা সুলভ ও সত্বর উপায়কেই যথার্থ উপায় বলে গণ্য করেন, নৈতিক বিচারকে অনর্থক বিবাদ মনে করেন। সমাজ কিন্তু সেই কর্তব্য ভোলেনি। ক্রেতা অধিকার আন্দোলন ব্যবসায়ীর চৌর্যবৃত্তিকে বার বার রুখে দিয়েছে। শিশুশ্রমিকের শৈশব চুরি, দরিদ্র শ্রমিকের মজুরি চুরির বিনিময়ে প্রস্তুত পণ্য বহু ক্রেতা প্রত্যাখ্যান করেছেন। পরিবেশবন্ধু উপায়ে নির্মিত পণ্যকে, প্রান্তিক মানুষদের স্বহস্তে প্রস্তুত পণ্যকে বিশেষ মূল্য দিয়েছেন। ক্রেতার নৈতিকতা-উৎসারিত গ্রহণ-বর্জন যথেষ্ট প্রভাবিত করেছে বৃহৎ সংস্থাগুলির বাণিজ্যনীতিকে। বাজার প্রক্রিয়াকে অনেকেই নীতিনিরপেক্ষ এক ব্যবস্থা বলে বিবেচনা করেন। বলা যেতে পারে, ক্রেতারা সেই ব্যবস্থায় বিবেকের ভূমিকা পালন করেছেন। আজও পথ দেখাচ্ছে নাগরিকসমাজ, রাষ্ট্র তাকে অনুসরণ করবে কি? বিচারে সিদ্ধান্ত যা-ই হোক, প্রশ্নগুলিকে ‘অবান্তর’ বলে সরিয়ে না রাখাই বিধেয়।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy