লোকসভা নির্বাচন বরাবরই এ দেশের রাজনীতিতে বড় পরীক্ষা। পরীক্ষা ভোটপ্রার্থীদের, প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলির, দলনায়ক এবং দলনায়িকাদের। কিন্তু এ বারের লোকসভা নির্বাচনে সবচেয়ে বড় পরীক্ষা ছিল ভারতীয় গণতন্ত্রের। অতিকায় শাসকের বিপুল আধিপত্যকে ছলে বলে কৌশলে বিপুলতর করে তোলার যে অভিযান এই নির্বাচনের পর্ব থেকে পর্বান্তরে উত্তরোত্তর প্রবল আকার ধারণ করেছিল, তার প্রতিস্পর্ধা গড়ে তোলার যথার্থ উপায় ছিল একটিই: বহুমত, বহুস্বর এবং বহুত্ববাদী গণতন্ত্রের জোরদার অনুশীলনের পথে ফিরে আসা। দেশের ভোটদাতারা প্রত্যয়ী সুবিবেচনার স্পষ্ট প্রমাণ দিয়ে রাজনীতিকে সেই পথে ফিরিয়ে এনেছেন। অগণন নাগরিকের দৈনন্দিন জীবনসংগ্রামের কঠিন সমস্যাগুলিকে তুচ্ছ করে সঙ্কীর্ণ ধর্মমোহ এবং বিভাজনী বিদ্বেষের প্লাবনে জনসাধারণকে ভাসিয়ে দিয়ে ‘সবার উপরে তিনিই সত্য’ ঘরানার একাধিপত্য কায়েম রাখার যে উদ্যোগ গোটা দুনিয়াকে শঙ্কিত করেছিল, এই জনাদেশ তাকে প্রতিহত করেছে। নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বেই যদি তৃতীয় বার এনডিএ সরকার গঠিত হয়, তা হবে সত্যকারের জোট সরকার। বস্তুত, মুখ্যমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তিনি এ-যাবৎ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় অভ্যস্ত ছিলেন, শরিক-নির্ভর সরকার চালানোর দায় এই প্রথম। এই অভিজ্ঞতাকে আপন অহমিকার কারণে বিড়ম্বনা মনে না করে তিনি এবং তাঁর সতীর্থরা যদি একে যথার্থ গণতন্ত্র অনুশীলনের সুযোগ হিসাবে দেখতে পারেন, তবে হয়তো তাঁদের মজ্জাগত অ-গণতান্ত্রিক ক্লেদ এবং গ্লানির কিছুটা সাফাই হলেও হতে পারে। মঙ্গলবার বাস্তবিকই জঙ্গল পরিষ্কার করার দিন হিসাবে খ্যাত হতে পারে।
এই নির্বাচনী ফলাফলকে কোনও সরল একমাত্রিক কার্যকারণসূত্র দিয়ে ধরা যাবে না, এর মধ্যে নিহিত আছে এক বিচিত্র এবং জটিল রাজনৈতিক বাস্তবের সমাহার। এক দিকে ওড়িশা বা অন্ধ্রপ্রদেশে বিজেপি ও শরিক তেলুগু দেশম পার্টির সাফল্য, অন্য দিকে উত্তরপ্রদেশের হৃদয়পুরে বিপর্যয়, পশ্চিমবঙ্গে অশ্বমেধের ঘোড়া ছোটাতে গিয়ে পপাত চ মমার চ; এক দিকে রাজস্থানে দলের বড় ক্ষয়ক্ষতি, অন্য দিকে সেই রাজ্যের দুই প্রতিবেশী গুজরাত ও দিল্লিতে অব্যাহত দাপট; এক দিকে সামগ্রিক ভাবে ভোটের অনুপাতে ২০১৯-এর থেকেও ভাল ফল করা, অন্য দিকে প্রায় ষাটটি আসন খুইয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানো— এই বহুমুখী ফল স্পষ্টতই ভারতীয় রাজনীতির বহুমুখী বিচিত্রতার পরিচয় দেয়। এ-বারের লোকসভা ভোটে ভারত আবার তার বৈচিত্রে ফিরে এসেছে, বিভিন্ন রাজ্য তথা অঞ্চল তথা জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন বাস্তব প্রতিফলিত হল— এখানেই এই নির্বাচনের ঐতিহাসিকতা।
বিরোধী শিবিরের পরিপ্রেক্ষিতে দেখলেও এই সত্যটিই অন্য ভাবে উন্মোচিত হয়। প্রথমত, কংগ্রেসের পুনরুজ্জীবন জানিয়ে দেয়, প্রধানমন্ত্রীর ‘কংগ্রেস-মুক্ত ভারত’ তাঁর আপন ‘মন কি বাত’ মাত্র, এই সর্বভারতীয় মধ্যপন্থী দলের প্রয়োজন এবং সম্ভাবনা দুইই বহাল রয়েছে। আবার, মহারাষ্ট্র বা উত্তরপ্রদেশের ফলাফল সঙ্কেত দেয় যে, সেই সর্বভারতীয় দলকে বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তির সঙ্গে কার্যকর ও বাস্তব-সচেতন সমন্বয়ের পথে যেতে হবে, তবেই সাফল্য মিলবে। তেমনই, ‘ইন্ডিয়া’ নামক মঞ্চটিকে, তার বহু সমস্যা এবং ঘাটতি সত্ত্বেও, ব্যর্থ বলে উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই— এই মঞ্চের শরিক বা সংশ্লিষ্ট দলগুলি অবশিষ্ট বিরোধী দলের তুলনায় অনেক ভাল ফল করেছে। অতঃপর সংসদে এবং সংসদের বাইরে তাদের বর্ধিত শক্তি ও নতুন উৎসাহের বাস্তবকে কাজে লাগিয়ে ইন্ডিয়া-র শরিকরা একটি কুশলী বিরোধী শিবিরের ভূমিকা পালন করতে পারবে কি না, ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে সেই প্রশ্ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই নির্বাচন কেবল শাসক নয়, বিরোধীদেরও একটি শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ দিয়েছে। আত্মশুদ্ধির সুযোগ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy