সংখ্যাগুরুর ইচ্ছা অনুযায়ী দেশ চলবে, এটাই আইন— ঘোষণা করেছেন ইলাহাবাদ হাই কোর্টের বিচারপতি শেখর কুমার যাদব। আদালতে বিচারপতির আসনে বসে নয়, কথাটি তিনি বলেছেন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের অনুষ্ঠানে। এক জন বিচারপতি কী করে এমন একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেন বা সেখানে বক্তৃতা করেন, বর্তমান ভারতে সেই সব প্রশ্নের আর কোনও স্থান নেই। কিন্তু উচ্চ আদালতের বিচারপতি সরাসরি সংখ্যাগুরুবাদ প্রচার করলে এ দেশে এখনও প্রশ্ন ওঠে। তাঁর এই বক্তব্যের প্রতিবাদ শোনা গিয়েছে বিভিন্ন মহল থেকে, তাঁকে বিচারপতির আসন থেকে অপসারণে উদ্যোগী হওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছেন কেউ কেউ। বাস্তবিকই, শ্রীযুক্ত যাদবের মন্তব্যটি গভীর ভাবে উদ্বেগজনক। আপন মতের বিশদ ব্যাখ্যা করে তিনি জানিয়েছেন, এই দেশের নাম হিন্দুস্থান, এখানে গরু, গীতা আর গঙ্গার পূজা হয়, এ দেশে প্রতিটি শিশুই রাম। তথ্য হিসাবে উক্তিটি উদ্ভট— হিন্দু নাগরিকদের এক বিপুল অংশের কাছে এই কথাগুলির কোনও অর্থই নেই। কিন্তু গবাদি (গো+আদি) দেবদেবীর উপাসকরা তথ্য বা যুক্তির ধার ধারেন না। হিন্দু কথাটিকে তাঁরা যে অর্থে বুঝতে চান সেটি আগমার্কা হিন্দুত্ববাদী অভিধান থেকে নেওয়া। তাঁদের অবস্থান ষোলো আনা রাজনৈতিক অবস্থান। সেই রাজনীতির নাম সংখ্যাগুরুতন্ত্র। তার বীজমন্ত্র: হিন্দুর দেশ হিন্দুর ইচ্ছা অনুসারেই চলবে।
‘সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকতা’ কেন বিশেষ ভাবে বিপজ্জনক, তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। কেবল তাত্ত্বিক পরিসরেই নয়, রাজনীতির ভুবনেও। স্বাধীন ভারতের প্রথম পর্বে এই বিষয়ে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন নেতানেত্রীর অনেকেই, জওহরলাল নেহরু যাঁদের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য। পরবর্তী কালে, বিশেষত উনিশশো আশির দশকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে সঙ্ঘ পরিবারের আগ্রাসী অভিযান এবং তার পরিণামে রাজনৈতিক হিন্দুত্বের প্রভূত সাফল্য বুঝিয়ে দিয়েছে, গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন রাজনীতিকদের সেই সতর্কবাণী কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এক দিকে নির্বাচনী গণতন্ত্রে সংখ্যাগুরুর শক্তিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে ‘হিন্দু’ সত্তাকে একজোট করা এবং অন্য দিকে সেই সত্তাটিকে উত্তরোত্তর অসহিষ্ণু ও আগ্রাসী করে তোলা— এই দ্বিমুখী কৌশল প্রয়োগে সঙ্ঘ পরিবারের বিরাম নেই। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সভায় বিচারপতি যাদবের উক্তি তারই অনুসারী।
বলা বাহুল্য, সংখ্যাগুরুতন্ত্রের এই ধারণাটি প্রকৃত গণতন্ত্রের বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে আছে। গণতন্ত্রে সংখ্যাগুরুর মতামত অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তার থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভিন্ন মত এবং জীবনাচরণের বিভিন্ন রূপ ও রীতিকে স্বাধীন অনুশীলনের সুযোগ দেওয়া, সমস্ত ধর্মমতের অনুসারীদের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং বিশেষত সমস্ত ধরনের সংখ্যালঘুর অধিকার রক্ষা করা। প্রসঙ্গত, এই মুহূর্তে প্রতিবেশী বাংলাদেশে সেই অধিকার নিপীড়িত হওয়ার নানা অভিযোগ প্রতিনিয়ত শোনা যাচ্ছে এবং তার বিরুদ্ধে ভারতের বিভিন্ন মহল থেকেও প্রতিবাদ সংগঠিত হচ্ছে। লক্ষণীয় এই যে, সেই প্রতিবাদে বিশেষ উৎসাহ সহকারে শরিক হচ্ছেন সঙ্ঘ পরিবারের অনুগামীরাও। বুঝতে অসুবিধা নেই যে, বাংলাদেশের হিন্দুস্বার্থের ‘পাশে দাঁড়িয়ে’ তাঁরা ভারতে আপন রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে তৎপর। কিন্তু এই তৎপরতা যে এক বিচিত্র পরিহাসের সৃষ্টি করছে, সেটা কি তাঁরা খেয়াল করেছেন? সংখ্যালঘুর স্বার্থ রক্ষা যদি গণতন্ত্রের ধর্ম হয়, তবে ‘সংখ্যাগুরুর ইচ্ছা’ সেই ধর্মের উপরে স্থান পায় কী করে? প্রতিবেশী দেশের জন্য যে নিয়ম, সঙ্ঘ পরিবারের আপন দেশে তার বিপরীত বিধান? স্পষ্টতই, তাঁদের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সঙ্গে প্রকৃত গণতন্ত্রকে মেলানোর কোনও উপায় নেই। সংখ্যাগুরুবাদ এবং গণতন্ত্র অনিবার্য ভাবে পরস্পরবিরোধী। শেখর কুমার যাদবের ভাষণ সেই সত্যকেই আরও এক বার উদ্ঘাটিত করেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy