Advertisement
০২ জুলাই ২০২৪
Julian Assange

ন্যায়-অন্যায় বিনিশ্চয়

প্রশ্নটি তুলে দিয়েছেন স্বয়ং জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। চোদ্দো বছর পর কারাগার থেকে বেরিয়ে এসেছেন তিনি— শর্তসাপেক্ষে।

জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। —ফাইল চিত্র

জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। —ফাইল চিত্র

শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০২৪ ০৯:০৮
Share: Save:

একশো পঁচাত্তর বছর আগে, আমেরিকার দাসপ্রথা বিলোপ নিয়ে উত্তর আর দক্ষিণের সংঘর্ষের মধ্যে উত্তরের ইউনিয়ন-পন্থীরা যখন কিছু কিছু ক্ষেত্র শত্রুর হাতে ছেড়ে দিতে রাজি হয়েছিলেন নিজেদের শর্তপূরণের অংশ হিসেবে, যন্ত্রণাবিদ্ধ হয়েছিলেন আমেরিকার উত্তরাংশের বহু মানবতাবাদী ‘প্রগতিবাদী’ মানুষ, যাঁরা কোনও শর্তেই দাসপ্রথাকে সমর্থন করতে রাজি ছিলেন না। অনেক কবি-লেখক কলম তুলে নিয়েছিলেন বিবেক-যন্ত্রণায়। ১৮৫০ সালের জুন মাসের আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ‘কমপ্রোমাইজ় পর্ব’ বলে পরিচিত এই সময়টিতে এঁরা লিখছিলেন, কী ভাবে সম্ভাবনার যাত্রাপথকে সমূহ ভাবে নষ্ট করে দিতে পারে— ‘সমঝোতা’। ওয়াল্ট উইটম্যানের একটি কবিতার একটি পঙ্‌ক্তি বহু-উদ্ধৃতিতে স্মরণীয়: স্বাধীনতার দুর্ভাগ্য যে শত্রুদের হাতে, নয়, বন্ধুদের হাতেই তা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়— “ফ্রম দ্য হাউস অব ফ্রেন্ডস কামস দ্য ডেথ স্ট্যাব”। পৌনে দু’শো বছর পর আর এক জুনে কি সেই আমেরিকার সূত্রেই আবার একই প্রশ্ন উঠতে চলেছে? আজও কি মানুষের স্বাধীনতা, বাক্‌স্বাধীনতা ধ্বস্ত হচ্ছে স্বাধীনতার বন্ধুরই হাতে— শত্রুদের ছেড়ে?

প্রশ্নটি তুলে দিয়েছেন স্বয়ং জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। চোদ্দো বছর পর কারাগার থেকে বেরিয়ে এসেছেন তিনি— শর্তসাপেক্ষে। যে মানুষটি বাক্‌স্বাধীনতার প্রশ্নে আক্ষরিক অর্থেই এত দিনে প্রবাদপ্রতিম, বিশ্ববিশ্রুত যাঁর নাম, তাঁর এই শর্তাধীন মুক্তি দেখে অনেকেই ভাবতে শুরু করেছেন যে, নিজের স্বাধীনতার বিনিময়ে তিনিই কি বাক্‌স্বাধীনতার নীতির ক্ষেত্রে ক্ষমতার সঙ্গে আপস করলেন— ‘কমপ্রোমাইজ়’? আমেরিকার চুক্তিমতো এ বার তিনি ১৯১৭ সালের গুপ্তচর আইন মোতাবেক বিচারাধীন হবেন, ও বিশেষ ‘ক্লাসিফায়েড’ তথ্য ‘বেআইনি’ ভাবে উদ্ধার ও সম্প্রচারের দায়ে সে দেশের জাতীয় প্রতিরক্ষা আইন অনুযায়ী তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হবে, এবং সম্ভবত বছর পাঁচেক তাঁকে আবারও জেল খাটতে হবে। উইকিলিকস-খ্যাত অ্যাসাঞ্জ জন্মপরিচয়ে অস্ট্রেলীয়, সুতরাং বিদেশি সাংবাদিক হিসাবে আমেরিকার গোপন তথ্য সংগ্রহ তাঁর পক্ষে আরও বড় অপরাধ হয়ে দাঁড়াতে পারে। ইতিমধ্যে আইনজীবীরা এও বলেছেন যে, অ্যাসাঞ্জ আসলে তো কোনও সাংবাদিক নন, তিনি ‘হ্যাকার’মাত্র, অর্থাৎ কম্পিউটারের গোপন তথ্য উদ্ঘাটনেই তিনি পারদর্শী। অথচ তাতে আইনের চোখে কোনও ব্যবধান হওয়ার কথা নয়, বাক্‌স্বাধীনতার প্রশ্নে হ্যাকার কিংবা সাংবাদিক উভয়েই ব্যক্তিনাগরিক হিসাবে একই অধিকার দাবি করতে পারেন। তদুপরি, এইটিই কি সন্ধিৎসু নাগরিকের কাজ নয় যে, রাষ্ট্র কোনও ভাবে অন্যায় বা দ্বিচারিতা করলে তা সমাজের সামনে তুলে ধরা? যে ভাবে অ্যাসাঞ্জ দেখিয়েছিলেন যে এই শতকের প্রথম দশকে ইরাক যুদ্ধ ও আফগানিস্তান যুদ্ধে আমেরিকান সেনাবাহিনী সে সব দেশের সাধারণ (অসামরিক) মানুষের উপর সঙ্গোপনে বোমাবর্ষণ করেছিল— আধুনিক ‘সংবাদ’ সন্ধিৎসুর কি সেই কাজটিই করা উচিত নয়? রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কথা বলার দরকার হলে তা করতে হবে— আধুনিক গণতন্ত্রের পরিপ্রেক্ষিতে মানবিক বিশ্বের কি এমনই হওয়ার কথা ছিল না? লিবারাল ও প্রগ্রেসিভ আদর্শের ধ্বজা উড়িয়ে যে দেশনেতৃত্ব বিশ্বের প্রধান শক্তি হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছেন, তাঁরা প্রথমত ন্যায়ের নামে অন্যায় ও অমানবিক কাজ করে চলবেন, এবং দ্বিতীয়ত, সে কথা কেউ জানতে পারলে তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহের অজুহাতে জেলে পুরে রাখবেন? মাঝখান থেকে চোদ্দো বছর জেলবাসের পর জেলমুক্তির জন্য অ্যাসাঞ্জ রাষ্ট্রের সঙ্গে ‘সমঝোতা’ করলেন— নিজের স্বাধীনতার বিনিময়ে বাক্‌স্বাধীনতার রাষ্ট্রনির্ধারিত সীমা মেনে নিলেন।

বিষয়টি তবে দাঁড়াল এই যে, অতঃপর অ্যাসাঞ্জকে তাঁর নিজের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে সীমিত জেলবাস করতে হবে এমন এক কাজের জন্যে, যে কাজটি সাংবাদিকরা রোজ করে থাকেন: সত্য উদ্ঘাটন। অর্থাৎ, তিনি মেনে নিলেন তাঁর কাজটি ছিল অন্যায়। অথচ, সত্য উদ্ঘাটনের কাজ কে কী ভাবে করছেন, এর থেকেও বড় কথা, তাঁরা কোন সত্য বার করে আনতে পারছেন। রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞার তলায় রাষ্ট্রেরই অপরাধের ঝুলি প্রতি দিন ভর্তি হতে থাকে, অ্যাসাঞ্জ দেখিয়েছিলেন। অথচ, আজ তাঁর সমঝোতা কি এই কথাই প্রতিষ্ঠা করছে না, তাঁর সেই অপরাধ উদ্ঘাটনের কাজটি ঠিক হয়নি? একুশ শতকের বৃহত্তম তথ্য-উদ্ঘাটনকারী উইকিলিকস-এর প্রণেতা যদি মেনেই নেন, তিনি যা করেছেন তা অন্যায়, তবে তাঁর মুক্তিতে জয় নেই, পরাজয়ই আছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

WikiLeaks freedom of speech
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE