নিচুতলার পুলিশকর্মীদের একাংশ টাকা খেয়ে বালি, কয়লা, সিমেন্ট চুরিতে মদত দিচ্ছে বলে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে, এমনই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দুর্নীতিগ্রস্তদের সরাতে হবে, সিআইডি-কে ঢেলে সাজাতে হবে, জানিয়েছেন পুলিশকর্তাদের সঙ্গে একটি বৈঠকে। তাঁর এই ‘কড়া বার্তা’ দেওয়ার ফল ফলছে প্রায় হাতে হাতে— সাসপেন্ড হয়েছেন পশ্চিম বর্ধমানের বারাবনি থানা, এবং মালদহের গাজলের দুই সাব-ইনস্পেক্টর, তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। পুলিশবাহিনী থেকে দুর্নীতি উৎখাত করতে যদি পুলিশমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী সক্রিয় হন, তাতে স্বস্তি পাওয়ারই কথা। কিন্তু কোনও বিশেষ তথ্য বা যুক্তি ছাড়াই মুখ্যমন্ত্রী যে কেবলমাত্র ‘নিচুতলার’ পুলিশ ও কর্মীদেরই দোষী ঠাহর করলেন, তাতে অস্বস্তি জাগতে বাধ্য। ‘উপরতলা’-র পুলিশ আধিকারিক, প্রশাসনিক কর্তারা যে ওই পাচার চক্রগুলোতে জড়িত নন, তা কি রাজ্য সরকার কোনও তদন্ত করে জানতে পেরেছে? তা না হলে কী করে ধরে নেওয়া চলে যে উপরতলার পুলিশ, আধিকারিক বা নেতারা দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত নন?
যদিও ভারতের রাজনৈতিক দলগুলি ঠারেঠোরে বোঝাতে চায় যে ভোটের ফলের উপর দুর্নীতির প্রভাব পড়ে না, কিন্তু দুর্নীতি বিরোধীর অস্ত্র হয়ে উঠলে সঙ্কটে পড়ে শাসক দল। তার মোকাবিলায় নিচুতলার নেতা-কর্মীদের উপর দুর্নীতির দায় চাপিয়ে, তাঁদের থেকে নিজেদের দূরত্ব তৈরির চেষ্টা করেন শীর্ষ নেতৃত্ব। পুলিশ বা সরকারি কর্মীকে সাসপেন্ড করে, কিছু নেতাকে পঞ্চায়েত বা পুর নির্বাচনে টিকিট না দিয়ে, শাসক দল ও প্রশাসনের কর্তব্য করার দায় রক্ষা করে। নিচুতলার কর্মীদের হাত পেতে ঘুষ নেওয়া সহজেই চোখে পড়ে। কিন্তু পাচার চক্রের মতো সংগঠিত অপরাধের ক্ষেত্রে বোঝাপড়ার বড় অংশটাই হয় জনচক্ষুর অন্তরালে। থানা স্তরের পুলিশ বা ব্লক স্তরের আধিকারিক উপরতলার নির্দেশের বাহকমাত্র। কেবলমাত্র নিচুতলার পুলিশ অফিসারদের জড়িত করে কয়েকটি ব্লক, এমনকি জেলার মধ্যে সমন্বয় করে কোটি কোটি টাকার পাচার চক্র বহু বছর ধরে চলছে, তা বিশ্বাস করা কঠিন। গরু ও কয়লা পাচার কাণ্ডে সিবিআই তদন্তকারীরা সংবাদ মাধ্যমে জানিয়েছিলেন, যে শ’খানেক ওসির নাম ওই দুই পাচার চক্রে উঠে এসেছে, তাঁরা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চার-পাঁচ বছর ধরে কয়লা এবং গরু করিডরের বিভিন্ন থানাতে পোস্টিং পেয়েছেন। এই পোস্টিং কি উপরতলার কর্তারাই করেননি? আর জি কর কাণ্ডে প্রমাণ লোপাটের দায়ে টালা থানার ওসি অভিজিৎ মণ্ডলকে সিবিআই গ্রেফতার করলে একটি বৈঠকে নিচুতলার শ’খানেক পুলিশকর্মী তৎকালীন নগরপাল বিনীত গোয়েলকে বলেন, তাঁরা আর ‘ওয়টস্যাপ কল’-এ উপরতলার নির্দেশ নেবেন না। কথাগুলি তাৎপর্যপূর্ণ।
একই ভাবে কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম একাধিক বার অবৈধ নির্মাণের দায় চাপিয়েছেন পুলিশ এবং পুরসভার ইঞ্জিনিয়ারদের উপরে। তা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে ইঞ্জিনিয়াররা জানিয়েছেন, রাজনৈতিক মদত ও প্রশ্রয় ছাড়া বেআইনি নির্মাণ কখনওই সম্ভব নয়। ‘কাটমানি’ নিয়ে ক্ষোভের মুখেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বার বার দলের নিচুতলার কর্মীদেরই দায়ী করেছেন। বিরোধীরা স্বভাবতই প্রশ্ন তুলেছেন যে, উপরতলার কর্তারা কী করছিলেন? কেন দীর্ঘমেয়াদি দুর্নীতি— পাচার, অবৈধ নির্মাণ, নিয়োগে অনিয়ম— চলাকালীন নীরব ছিল প্রশাসন, পুরসভা, শাসক দল? প্রশ্নটি যথার্থ। অধস্তন কর্মীদের দুর্নীতি, অবহেলার দায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের উপরেই বর্তায়। তবে মমতা নিজে আরও কৌতূহলপ্রদ একটি প্রশ্ন করেছেন বৈঠকে। অভিযুক্ত অফিসারদের সরিয়ে দেওয়ায় কেউ বাধা দিলে তিনি শুনবেন না, তা জানিয়ে বলেছেন, “আমি নিজের কথাও শুনব না!” প্রশাসকের এই খণ্ডিত সত্তাই রাজ্যের সঙ্কট।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy